‘সমন্বয়হীনতার কারণে মানব পাচার থামানো যাচ্ছে না’

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দিচ্ছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন।
ছবি: প্রথম আলো

‘পরিকল্পনার দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে মানব পাচার থামানো যাচ্ছে না। মানব পাচার ঠেকানোর ক্ষেত্রে সরকারের সর্বস্তরেই সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সবাই যদি সতর্ক না হন, তাহলে মানব পাচার থামানো যাবে না।’

কক্সবাজারে মঙ্গলবার দুপুরে ‘মানব পাচারের ভুক্তভোগীদের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। শহরের একটি রেস্তোরাঁর সম্মেলনকক্ষে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। বৈঠক আয়োজনে সহায়তা করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলীর সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন, আইওএম কর্মকর্তা নাজমুন নাহার, একশনএইড বাংলাদেশের কর্মকর্তা নুজুলি বেগম, কক্সবাজার জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক লিটন কান্তি চৌধুরী, কক্সবাজার সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) প্রকল্প ব্যবস্থাপক শাহিদা পারভিন, কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাকী-এ-কাউছার, হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী, ইসলামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর ছিদ্দিক, ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আলম, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ন্যাশনাল ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর মো. আলমগীর কাদেরী, কক্সবাজার জজ আদালতের আইনজীবী বিশ্বজিৎ ভৌমিক প্রমুখ।

বৈঠকে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, দেশের জিডিপি বাড়লেও যাঁরা গরিব, তাঁরা আরও দরিদ্র হচ্ছেন। মানব পাচার বাড়ার পেছনে এটিও কারণ। মানব পাচার বন্ধে সরকারি ও বেসরকারি সব সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পারস্পরিক দূরত্ব কমাতে হবে। মানব পাচারের ভুক্তভোগীদের সমাজে প্রতিষ্ঠা করার যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, মানব পাচারের শিকার মানুষকে যোগ্যতা অনুযায়ী জীবিকায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যাঁরা মানব পাচার নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের ভুক্তভোগীদের কাছে গিয়ে তাঁদের কথা শুনতে হবে।

অদক্ষ জনশক্তি বিদেশে যাওয়ার পরও পাচারের শিকারের হয় জানিয়ে কক্সবাজার জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক লিটন কান্তি চৌধুরী বলেন, বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই পাসপোর্ট করার প্রয়োজন পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যার বয়স ১৬ বছর বয়সী ব্যক্তি পাসপোর্টে বয়স লেখেন ২৭ বছর। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য কোনো কর্মীকে জনশক্তি কার্যালয়ে হাজির হতে হয় না, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই দায়িত্ব নিয়ে ফেলে। এভাবে অদক্ষ জনশক্তি বিদেশে গিয়ে পাচারের শিকার হচ্ছেন।

একশনএইড বাংলাদেশের কর্মকর্তা নুজুলি বেগম বলেন, ‘পরিকল্পনার দুর্বলতার কারণে আমরা ভুগছি। যারা পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে সুরক্ষা দিতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি কার্যকর করে পাচার বন্ধ করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ ও এর জনশক্তিকে পরিকল্পনায় নিয়ে আসতে না পারলে কাজ হবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব স্তরেই সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।’

আইওএম কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো মানব পাচার বন্ধের লক্ষ্যে কাজ করে চলছে। তবে সরকারের দায় আরও বেশি। বিশেষ করে ব্যক্তির সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য সরকারকে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে।

কক্সবাজার জজ আদালতের আইনজীবী বিশ্বজিৎ ভৌমিক বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধে তিনটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এসব ট্রাইব্যুনালে ৬৩৮টি মামলা বিচারাধীন। পুলিশি তদন্তের জন্য রয়েছে আরও ৩৬০টি। পাচারের শিকার ব্যক্তি ও সাক্ষীদের আদালতমুখী করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাকী-এ-কাউছার বলেন, মানব পাচারে যুক্ত সংঘবদ্ধ চক্রের চিত্র পুলিশের অভিযোগপত্রে তুলে আনতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও আইনজীবী—দুই পক্ষকে সচেতনভাবে কাজ করতে হবে।

মানব পাচার মামলার বিচারে ধীরগতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘দেশের ভেতরেও মানব পাচার হয়। ২০১৩-১৪ সালে অনেক মানব পাচার মামলার তদন্ত করেছি। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এসব মামলার একটিতেও সাক্ষীর ডাক পড়েনি। তাহলে বুঝতে হবে বিচারকাজ ধীরগতিতে হচ্ছে।’

ইউএনএফপিএর ন্যাশনাল ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর মো. আলমগীর কাদেরী বলেন, নিরক্ষর ও কম শিক্ষাগত যোগ্যতার মানুষের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরাও এখন নানাভাবে পাচারের শিকার হচ্ছেন। এখন সেদিকেও নজর দিতে হবে।

বিএনপিএসের প্রকল্প ব্যবস্থাপক শাহিদা পারভিন বলেন, যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে কর্মী পাঠাচ্ছে, তাদের ডেটাবেজ তৈরি করে সরকারকে তদারকি বাড়াতে হবে।

হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, টেকনাফের হ্নীলায় পাঁচটি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে। এসব শিবিরে দালাল চক্র খুবই সক্রিয়। তাঁদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি।
ইসলামাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান নুর ছিদ্দিক বলেন, বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করার নিয়ম থাকলে পাচার কমে যেত।

ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের অনেক বাসিন্দা পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঢুকে মানব পাচারের চেষ্টা করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।