ডায়ালাইসিস করতে গিয়ে তাঁরা সর্বস্বান্ত, পাশে দাঁড়াল চমেক রোগী কল্যাণ সমিতি

চমেক হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা নিচ্ছেন প্রফুল্ল কুমার নাথ
ছবি: জুয়েল শীল

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল মো. আলমগীরের (৪৫)। তিনি বিদেশে ছিলেন। ভালোই আয় ও সঞ্চয় হচ্ছিল তাঁর। কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁকে ২০১৪ সালে দেশে ফিরে আসতে হয়। চিকিৎসার পেছনে ব্যয় হতে থাকে তাঁর সঞ্চয়।

২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় ডায়ালাইসিস। মাসে আটবার ডায়ালাইসিস, ওষুধ, রক্ত—এসবের ব্যয় মেটাতে গিয়ে একসময় নিঃস্ব হয়ে পড়েন আলমগীর। এখন তিনি পথের ভিখারি।

আলমগীরের স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে আছে। জীবন বাঁচাতে, সংসার চালাতে স্ত্রী শামসুন নাহারকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট খাজা রোড, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ভিক্ষা করেন আলমগীর।

ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে আলমগীরের মতো আরও অনেককে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়েছেন। এমন পাঁচ ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতি। আগামী ছয় মাস তাঁদের বিনা মূল্যে হাসপাতালে নতুন চালু হওয়া মেশিনে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করেছে সমিতি। এ ছাড়া একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকেও সমিতি একই সুবিধা দেবে। এ জন্য প্রতিজনের পেছনে সমিতির খরচ হবে ২০ হাজার টাকা করে।

অসহায় পাঁচ রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা-ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। এতে তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। একদিকে নিজের অসুস্থতা, অন্যদিকে সংসার—এই দুই সামলাতে মানুষের কাছে হাত পাতা ছাড়া তাঁদের আর কোনো বিকল্প ছিল না।

চুক্তির আওতায় চমেক হাসপাতালে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবা দিয়ে আসছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যানডর। স্যানডরের ডায়ালাইসিস সেবায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। সম্প্রতি স্যানডর ডায়ালাইসিসে ফি বৃদ্ধি করে। ৫ শতাংশ হারে ফি বৃদ্ধির বিষয়টি ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

একই সঙ্গে স্যানডরের ডায়ালাইসিসে সরকারি ভর্তুকিসুবিধা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েন অনেক রোগী। অবশ্য বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে গত রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্যানডরের ডায়ালাইসিসে সরকারি ভর্তুকিসুবিধা আপাতত আগের মতোই রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

স্যানডরে ডায়ালাইসিস ফি ভর্তুকিসহ এখন ৫৩৫ টাকা। ভর্তুকি ছাড়া নিয়মিত ফি ২ হাজার ৯৩৫ টাকা। এর বাইরে কিডনি রোগীদের রক্ত দেওয়া, ইনজেকশন ও ওষুধ বাবদ আরও খরচ রয়েছে।

কিডনি রোগী ও স্বজনদের বিক্ষোভের পর চমেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নতুন ১০টি ডায়ালাইসিস মেশিন বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে চারটি ডায়ালাইসিস মেশিন বসেছে। এক মাসের মধ্যে সব কটি মেশিন চালুর আশা করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখানে প্রতি ডায়ালাইসিসে খরচ পড়ছে ৪১৭ টাকা।

চমেক হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডায়ালাইসিসের মূল্যবৃদ্ধির পর অনেক রোগী অসহায় হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্য থেকে আমরা ছয়জনকে খুঁজে বের করি। তাঁদের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন। সমিতির টাকায় হাসপাতালের মেশিনে তাঁদের ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

আলমগীর ছাড়া অপর পাঁচ রোগী হলেন প্রফুল্ল কুমার নাথ (৫৯), মো. ইলিয়াছ (৪৩), মো. নুরুন্নবী (৩০), ইলিয়াস (৪৮) ও মো. মামুন (৩০)। তাঁদের প্রত্যেকের রয়েছে করুণ গল্প।

মিরসরাইয়ের অধিবাসী প্রফুল্লের কথাই ধরা যাক। নগরের কদমতলীতে তাঁর গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসা ছিল। আর্থিক অবস্থা ভালোই ছিল তাঁর। ২০০০ সাল থেকে তাঁর ডায়ালাইসিস শুরু হয়। ২০০৬ সালে তাঁর স্ত্রী দীপু রানী দেবী তাঁকে একটি কিডনি দান করেন। ভারতে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। বেশ কয়েক বছর তিনি ভালো ছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে তাঁকে পুনরায় ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়। এখন মাসে তাঁর ১২টি ডায়ালাইসিস নিতে হয়।

প্রফুল্ল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমার চিকিৎসার পেছনে ৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। দোকান বিক্রি করেছি। ভিটাবাড়ি বিক্রি করেছি। যাবতীয় সঞ্চয় শেষ করেছি। ২০১৭ সালে স্যানডরে যখন ফি ৩৯৩ টাকা ছিল, তখন থেকে ডায়ালাইসিস করছি। এখন মানুষের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে ডায়ালাইসিস করি। দুই মেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করে কিছুটা সাহায্য করে।’

নগরের মতিয়ারপুল এলাকায় ছোট একটা বাসা নিয়ে স্ত্রী-দুই মেয়েসহ থাকেন প্রফুল্ল। স্ত্রী কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। ব্যবসায়ী বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে প্রতি মাসে প্রফুল্ল সাহায্য নেন। মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা যায় তাঁর চিকিৎসার পেছনে। প্রফুল্ল বলেন, ‘এখন আমি প্রতিদিনের ভিখারি।’

ফটিকছড়ির মো. ইলিয়াছের কাহিনি আরও করুণ। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে ছিলেন। সেখানে থাকাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিন বছর আগে দেশে ফিরে আসেন। এখন তিনি স্ত্রী ও দুই মেয়ে ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়িতে থাকেন। ভিক্ষা করে চলেন। তিনি বলেন, ‘বিদেশে থাকাকালে আমার সংসার ভালোভাবেই চলছিল। দেশে ফিরে আসার পর ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়। চিকিৎসা, ডায়ালাইসিস, আসা-যাওয়া, খাওয়া—সবকিছু মিলে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা করে খরচ হতে থাকে। এখন আমি নিঃস্ব। গাড়িতে ভিক্ষা করি। এলাকার মানুষের কাছে হাত পাতি।’

হালিশহরের মো. নুরুন্নবী একসময় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। এখন তিনি নিজ এলাকায় ভিক্ষা করেন। তাঁর মাসে আটটি ডায়ালাইসিস দরকার হয়। পাঁচ বছর ধরে ডায়ালাইসিস চলছে। চিকিৎসাবাবদ মাসে তাঁর খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘হালিশহরে গার্মেন্টসের পাশে বসে থাকি। মানুষের কাছে টাকাপয়সা চাই। এভাবে কোনোরকমে এখনো বেঁচে আছি।’

সন্দ্বীপের বাসিন্দা ইলিয়াস এইচএসসি পাস করে গার্মেন্টসে চাকরি নেন। পরে তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। ২০১৯ সাল থেকে তাঁর ডায়ালাইসিস শুরু হয়। এখন তিনি মানুষের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মো. মামুনও অসহায়। তাঁর পাশেও এসে দাঁড়িয়েছে রোগী কল্যাণ সমিতি। সমিতির উদ্যোগে তাঁকে বিনা মূল্যে চমেকের মেশিনে ডায়ালাইসিস–সুবিধা দেওয়া হবে।

রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্যসচিব সমাজসেবা কর্মকর্তা অভিজিৎ সাহা বলেন, ‘ডায়ালাইসিসের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই রোগীরা বিপাকে পড়েন। অনেকের ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে যায়। এখন সমিতির সহায়তায় তাঁদের বিনা খরচে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’