গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকলে তার প্রধান শিকার হন শ্রমিকেরা। কোনো দেশে সে রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে শ্রমিকেরা তাদের নায্য দাবির কথা তুলতে পারেন না, নানা ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয় তাঁদের। ভয়ভীতির মধ্যে তাঁদের থাকতে হয়। এমনকি প্রাপ্য মজুরির কথা বলতে গেলেও হামলা–মামলার শিকার হতে হয়। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের সংকট হয় বহুমুখী। নিরাপত্তাহীনতা, পুষ্টিহীনতাসহ শারীরিক–মানসিক নানা রকম সমস্যায় পড়েন নারী শ্রমিকেরা।
‘নারী, মজুরি প্রশ্ন ও শ্রমিক আন্দোলন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। সভায় অর্থনীতিবিদ, গবেষক, শ্রমিকনেতা ও নারীনেত্রীরা অংশ নেন। আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। এই সভা থেকে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করা, ৬০ ভাগ মহার্ঘভাতা দেওয়া, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ সাত দফা দাবি তোলা হয়।
সভায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, একটি দেশে যদি গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকে, তাহলে এর প্রধান শিকার হন শ্রমিকেরা। কারণ, তাঁরা সংগঠিত হতে পারেন না, দাবির কথা তুলতে পারেন না, মজুরির কথা বলতে পারেন না। নারী শ্রমিকেরা এর শিকার বেশি হন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে গণতন্ত্রের কথা থাকতে হবে, তেমনি নির্বাচনের বা গণতন্ত্রের অধিকারের কথার মধ্যে শ্রমিকের অধিকারের বিষয় জোরালোভাবে থাকতে হবে। এই পারস্পরিক বিষয়টি নিশ্চিত না করতে পারলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। তিনি বলেন, নারী শ্রমিকেরা অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁদের চাকরি চলে যায়। আবার যাদের শিশুসন্তান আছে, তাঁরাও চাকরি করতে গিয়ে নানা জটিলতার মুখে পড়েন।
শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয়কাঠামোয় গত কয়েক দশকে পরিবর্তন এসেছে বলে জানান গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ১৯৮০–৯০ সাল পর্যন্ত শ্রমিকদের প্রধান চাহিদা ছিল খাওয়া, থাকা ও চিকিৎসা। এখন তা বদলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রমিকেরা যতটুকু আয় করেন, তার বড় অংশ ব্যয় হয় সন্তানদের শিক্ষা, পুষ্টি ও যাতায়াতে। কিন্তু এগুলো তার মজুরিকাঠামোর ভেতরে নেই। সুতরাং শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি নির্ধারণই যথেষ্ট নয়, মজুরিকাঠামোতেও পরিবর্তন আনা জরুরি।
মিথ্যা মামলার কারণে শ্রমিকদের অধিকারের দাবি তোলাও এখন কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, সবশেষ মজুরি বাড়ানোর আগে যে আন্দোলন হয়েছিল, সে সময় অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল। এখনো শ্রমিকদের ভয়ভীতির মধ্যেই থাকতে হয়।
সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের ওপর হুমকি আসছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান। তিনি বলেন, হত্যা, আইন ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার হুমকি—এগুলো কথা বলার জায়গা কমিয়ে আনছে।
অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, তৈরি পোশাক খাতে এখন ৬০ ভাগ শ্রমিক নারী, যা এক দশক আগে ছিল ৮০ ভাগ। বর্তমান সময়ে নারী শ্রমিকেরা যা আয় করেন তা দিয়ে তাদের পক্ষে পুষ্টিকর খাবার কেনা সম্ভব হয় না। এতে নারী শ্রমিকদের দক্ষতা কমছে।
গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেনের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন গবেষক রেহনুমা আহমেদ, মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম, আইনজীবী আইনুন্নাহার, নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ প্রমুখ।