ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সম্মেলন
সাম্প্রদায়িক অপশক্তি শক্তিশালী হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধভাবে রুখতে হবে
সাংস্কৃতিক কর্মীরা এখন মানুষের মনে আগের মতো সেই আবেগ-আবেদন জাগাতে পারছেন না। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নানাভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। গণতন্ত্রের কথা বলে এই অপশক্তিকে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্য হয়ে এই অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অষ্টম জাতীয় সম্মেলনে এসব কথা উঠে আসে। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আজ শনিবার ওই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ গড়ে তুলুন’ আহ্বান নিয়ে এই সম্মেলনের অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মন্ত্রী বলেন, গণমানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী চেতনা জাগাতে মুক্তিযুদ্ধের সময়, এমনকি ৪০ বছর আগেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের যে ভূমিকা ছিল, এখন তা নেই। সাংস্কৃতিক কর্মীরা এখন আর মানুষের মনে আগের মতো সেই আবেগ-আবেদন জাগাতে পারছেন না। নতুন কোনো উদ্দীপনামূলক গান, নাটক, যাত্রাপালা—এসব আর দেখা যাচ্ছে না। অথচ অপর দিকে সাম্প্রদায়িক শক্তি নানাভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা যেসব অপপ্রচার চালাচ্ছে, তার উপযুক্ত জবাব দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘অতীতের চেয়ে এখন সাম্প্রদায়িক শক্তি বেশি বিস্তৃত হয়েছে। নারীদের ওপর আক্রমণ ও ধর্মকে ব্যবহার করে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমাদের দুর্বলতার কারণেই তারা মাথাচাড়া দিচ্ছে।’
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, কেবল সরকারই সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে—এই ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। সরকার তার ভূমিকা রাখবে। তবে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে নাগরিক সমাজ, সংস্কৃতিকর্মী সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাস দমনে কাজ করতে হবে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া অধ্যাপক শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, ‘বিপুল আত্মত্যাগ ও চরম মূল্য দিয়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। একটি উদার মানবিক গণতান্ত্রিক মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আবার সমাজের বিভেদ সৃষ্টি করছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে।’
আলোচনা পর্বে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, গত ৩২ বছর নানা সংকট ও প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে তাদের আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার পথ সুগম হয়েছে। তিনি শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ নির্মূল কমিটির সঙ্গে যুক্ত সব প্রয়াত নেতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, ‘যে গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ গঠনের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেই সমাজ গঠনের পথ থেকে এখন অনেক দূরে সরে গেছি। রাষ্ট্রীয় আচরণের মধ্যে প্রত্যাশিত ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে না।’
আজ প্রবীণ রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন ৮১ বছর বয়সে পদার্পণ করলেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার আগে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে ফুল দিয়ে ও উত্তরীয় পরিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, সংবিধান, চার মূলনীতি, যুদ্ধাপরাধের মতো মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আবার পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি বিতর্ক সৃষ্টি করছে। গণতন্ত্রের কথা বলে এই অপশক্তিকে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে কোনো আপস চলবে না। ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রতিহত করতে হবে।
নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও সমাজ সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে চলে যাচ্ছে। তিনিও বলেন, সাংস্কৃতিক কর্মীরা আগে যেভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন, এখন সেভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন না। অনেক সময় প্রশাসনের ভেতর থেকেও কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে থেকে তার নজির রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাস্তবতা ও ২০১৪ সালের বাস্তবতা এক নয়। এখন সমাজের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির সক্রিয়তা বাড়ছে।
মূল অধিবেশনে আরও আলোচনা করেন সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সঞ্চালনা করেন শহীদসন্তান আসিফ মুনীর।
এর আগে সকালে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অষ্টম জাতীয় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক গবেষক শাহরিয়ার কবির।
দুপুরে মূল অধিবেশনের পরে বিকেলে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সন্ধ্যায় সমাপনী অধিবেশন।