কেন ‘ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই’
কবে বাড়িতে সমানে সমানে সামাল দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হবে সে অপেক্ষার সুযোগ আমার আপনার বা এই সময়ের যেকোনো আর্থ সামাজিক অবস্থার নারীর কই?
নারী দিবসে দেশের বৃহত্তম টেলকো কোম্পানি ‘ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই’ লিখে এক নারী উদ্যোক্তার বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর থেকে কদিন আড্ডায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব ঝড় বয়ে গেল। নারীকেই কেন ঘর সামলে ব্যবসা করতে হবে, ঘর না সামলে শুধু ব্যবসা করাও যে ঠিক আছে কিংবা ব্যবসা না করে শুধু ঘর সামলানোও যে দারুণ কৃতিত্বের—আধুনিক একটা কোম্পানি এই সামান্য কথাটা ২০২৩ সালেও কেন বোঝে না, সেসব নিয়ে অনেক সমালোচনা আর বিতর্ক। সত্যিই তো, নারীকে কেন সবই পারতে হবে?
নারীকেই কেন সর্বজয়া মা দুর্গা হতে হবে? সংসার তো নারীর একার নয়, তাহলে ঘর নারী একা সামলাবে কেন! এসব নানা তাত্ত্বিক এবং আদর্শিক তর্কে গত কিছুদিন যত বেশি সময় দিলাম, নিজের মনের ঝড়ও তত বাড়তে থাকল! যত তর্ক করি, সে তর্ক নিজের বুকেই বুলেটের মতো বিঁধে!
সমাজে যেহেতু ঘরের কাজ, সন্তান পালন, স্বামীসহ পরিবারের সবার দেখভাল করার কাজকে নারীর কাজ হিসেবে ধার্য করে রাখা হয়েছে, তাহলে আমাদের উপায়টা কী? অপেক্ষা করব যত দিন ঘর সামলাতে আর কেউ এগিয়ে না আসবে? তত দিন কিছুতেই ব্যবসা সামলাতে যাব না?
তাহলে এই যে ঘরের সব সামলে, নানা কিছু মেনে নিয়ে আবার অনেক কিছু না মানতে পেরে প্রতিদিনের সব অবহেলা, অন্যায্য আচরণ মনে নিয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কম ঘুমিয়ে, নিজের দিকে কম তাকিয়ে, শরীর আর মনের সব শক্তি এক করে বাইরে বেরিয়ে ‘ব্যবসা সামলে’ (এই লেখায় ব্যবসা বলতে যেকোনো রোজগেরে কাজকে বুঝতে হবে) নিজের নগদ আয় আর নগদ সঞ্চয়ে কিছু সিদ্ধান্ত কিনে নিতে পারছি, তা–ও কি হারাতে হবে?
ঘরের কাজের শেষ নেই, কিন্তু এই সমাজে ঘরের কাজের মূল্যও তো নেই! নারী নাকি মায়ের জাত, সতত স্নেহশীলা বলে তার সারা দিন খেটে মরাতেই আনন্দ। কিন্তু বাড়ির লোকে তবু বলবেন কী এমন করো, সারা দিন তো বাসাতেই থাকো! আজ কেন নুন কম, কাল শার্ট কেন যথেষ্ট সাদা হয়নি এমন নানা বিষয়ে জবাবদিহি চলতেই থাকবে! আর ঘরের কাজে সহযোগী থাকলে তো কথাই নেই, তাহলে নারীর সে ঘরে তার শ্রম নিয়ে টুঁ–শব্দ করারও উপায় নেই! কারণ, সব নাকি ওই সহযোগীই করছে। গৃহকর্ম যেমন কোনো কাজ নয়, এর ব্যবস্থাপনারও কোনো দাম নেই, স্বীকৃতিও নেই।
কিন্তু পুরুষ হলে এমএ, বিএ পাস দুই অধস্তন সহকর্মীকে সামলাতে গিয়ে মেজাজ বিগড়ে বাড়ি ফিরে ইচ্ছেমতো চিৎকার করাও জায়েজ আছে। তার ওপর নারীর নেই বাপের বাড়ি কিংবা স্বামীর বাড়ির কোনো ঘর বা সম্পদে ওয়ারিশ হওয়ার নিশ্চয়তা! তাহলে নারীর কি শুধু ঘর সামলে খুশি থাকলে চলবে? নিজের জন্য কিছুই গোছাতে হবে না? দুর্দিনে–দুর্বিপাকে তাকে দেখবে কে?
সামলানোর তালিকা লম্বা
উন্নয়ন সংস্থাগুলো কিংবা দরিদ্র দেশের সরকারগুলো যখন অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর নারীদের গরু, মুরগি, ছাগল এসব সম্পদ হস্তান্তর করে সেসব পালন থেকে অর্জিত অর্থে অতি দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার মডেল নিয়ে কাজ করে; অনেক তাত্ত্বিক সমালোচনা করেন যে এর ফলে নারীর ওপর ঘরের কাজের চাপের পাশাপাশি আরও দ্বিগুণ বোঝা বা ডাবল বার্ডেন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আর এস্তার ডুফলোর গবেষণা বলছে, নারীদের প্রায় সবাই কোনো ব্যর্থতা ছাড়া ওইটুকু সম্পদ হাতে পেলেই পরিবারের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়ে ফেলতে পারছেন। সেসব ঘরে গিয়ে আমরা শুনি, স্বামী আগে প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পর রুটিন করে বউ পেটাতেন। কারণ, বাড়ি ফিরেই স্বামী যখন দেখতেন চালের অভাবে চুলা জ্বলেনি আজ, তখনই মাথায় আগুন ধরে যেত! কাজেই নারী যখন অতি দরিদ্র ঘর সামলে ব্যবসা সামলাতে শুরু করেছেন, তখন বরং দেখা যাচ্ছে এই চাল নিয়ে কথা–কাটাকাটি, মার খাওয়া অনেকটা বন্ধ হচ্ছে এবং শিশুরা প্রতিদিন নিয়মিত খাবার পাচ্ছে ও স্কুলে যাচ্ছে।
তবে নারীকে সামাল দেওয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার কোনো উপায় তাতে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং আমাদের মাঠের অভিজ্ঞতা বলে, এই নারীদের অর্থনৈতিক উত্তরণের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে তারই আসলে ঘর সামলে, গরু–মুরগি সামলে সেই দুধটুকু বা ডিমগুলো নিয়ে নিজেরই বাজারে যাওয়া ভালো। বাড়ির পুরুষ পণ্য বিক্রি করতে গেলে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে চা, বিড়ি, সিগারেট কিংবা নানা রকম খুচরা ধার শোধে টাকা খরচ হয়ে যায়।
এর ফলে নারীর কাছে প্রতিবার পণ্য বিক্রির পর একই পরিমাণ টাকা আসে না, অনেক সময় কোনো টাকাই আর তার কাছে পৌঁছায় না! আবার অনেক সময় শুধু ঘরে বসেই ব্যবসা করব, এমন ভাবলে যত পরিশ্রম তত রোজগার হয় না। সেলাই মেশিন নিয়ে ঘরে বসে কাজ করলে যত রোজগার আর মেশিন নিয়ে বাজারে দোকান দিয়ে বসলে প্রায় একই কর্মঘণ্টা ব্যয় করে রোজগারে বিরাট পরিবর্তন আনা সম্ভব।
তাই আমরা এখন উল্টো নারীকে বলছি, ঘর সামলান, ব্যবসা সামলান, ব্যবসা সামলাতে বাজারে যান, সমাজ পাড়া প্রতিবেশী স্থানীয় বাজার কমিটি বাজারে যেতে বাধা দিলে তাদের সামলান, বাজার পর্যন্ত গিয়ে যেহেতু দোকান দিয়ে বসলেও দেখবেন নারীর জন্য কোনো শৌচাগার নেই, তাই প্রস্রাবের বেগ সামলান এবং এরপর আশপাশের কোনো বাড়ির সহমর্মী মালিককে সামলে তার শৌচাগার ব্যবহারের ব্যবস্থা করে, সারা দিন বাজারে ব্যবসা সামলে, রাস্তার হাজার ঝক্কি সামাল দিয়ে নিজ রোজগার নিজ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে রোজগারের একটা অংশ বিপদ–আপদের জন্য সামলে রাখেন।
কবে সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষ হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক অনগ্রসর প্রথার শিকল ভেঙে সব সামালে হাত দেবে, তারপর নারীকে বলব তার পছন্দের সামাল দেওয়ার ক্ষেত্র বেছে নিতে বা কবে বাড়িতে সমানে সমানে সামাল দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হবে, সে অপেক্ষার সুযোগ আমার, আপনার বা এই সময়ের যেকোনো আর্থসামাজিক অবস্থার নারীর কই?
বছরের পর বছর একই গল্প
আপনার বাড়িতে কাজ করে যেই মেয়েটি ঢাকার কোনো বস্তি থেকে এসে তার সঙ্গে কথা বললে দেখবেন, গ্রামের বাড়িতে নানা ঋণের চক্করে পড়ে ঢাকায় এসেছে স্বামী–স্ত্রী মিলে কিছুদিন রোজগার করে সব ঋণের বোঝা ঘাড় থেকে নামিয়ে বাড়ির বন্ধক দেওয়া জমি ছাড়িয়ে কিংবা নতুন জমি কিনে ফিরবে এই স্বপ্ন নিয়ে! ঢাকা এসেই নিজের ঘর সামলানোর পাশাপাশি আরও চার থেকে পাঁচটি বাড়িতে ঘর সামলানোর কাজে হাত লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা রোজগার শুরু করে দেয়।
স্বামী সাধারণত সেই টাকার পাই পাই হিসাব নেয়, তাতেই চা, সিগারেট, আড্ডা সব চলে! আর আমাদের বাড়ির ঠিকা বুয়ারা মাসের ১৫ তারিখ থেকে আবার আমাদের কাছে ধার চাইতে থাকে, নইলে বাড়িতে চাল নিয়ে সন্তানকে খাওয়ানোর উপায় থাকে না, স্কুল ভর্তির ফি কিংবা নিজের ডাক্তার দেখানোর এক–দুই হাজার টাকাও কখনো জমা থাকে না তাদের কাছে।
স্বামী বলে, বাড়িতে টাকা পাঠায় জমি ছাড়ানোর জন্য! অথচ অনেক মাস পর যখন বাড়ি যায়, সেই টাকা পাঠানোর কোনো হদিস পায় না নারী। অনেক নারী তার শহরের রোজগারের একটা অংশ অনেক বিশ্বাস করে পাঠায় তার মায়ের পেটের ভাইকে, বাপের ভিটায় অধিকার না দিক, আশপাশে ঘর তোলার মতো একটা জমি যাতে ভাই কিনে রাখে, সে জমিরও হিসাব কখনো ভাইয়েরা মিলিয়ে দিতে পারে না!
বছরের পর বছর ধরে এসব গল্প শুনতে শুনতে আমি তাই আমার ঘর সামলানোর সহকারীদের বলি, ঘর সামলানো, ব্যবসা সামলানোর পাশাপাশি নিজের রোজগারও নিজের সামলে রাখতে হবে, পুরোটা নিজে সামলানোর অধিকার চাইলে ব্যবসা সামলানোই বন্ধ হতে পারে সে আশঙ্কা থাকলে বরং আগেই কিছুটা রোজগার সামলে ফেলতে হবে, মোবাইল ফোন কিনতে হবে, মোবাইলে বেতন নিতে হবে, সেই পাসওয়ার্ড আবার নিজেই সামলে রাখতে হবে!
মধ্যবিত্ত বাড়িতেও নারীর ঘর সামলে, ব্যবসা সামলে আনা টাকার সিংহভাগ খরচ হয়ে যায় সংসারের পেছনে। কিন্তু নারীর রোজগারের অর্থে তাঁর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, বাড়িতে ঢোকার পর কীভাবে সে অর্থ ব্যয় হবে, তাতেও তাঁর সিদ্ধান্ত থাকে না। কাজেই সেই অর্থের অবদানে যখন স্থাবর সম্পদ কেনা হয়, তখনো তাতে স্ত্রীর নাম যুক্ত হয় না। তখন স্বামী বলেন, মালিকানা একজনের নামে হলেই হলো! আর এই নিয়ে স্বামী, ভাই, এমনকি বাবার সঙ্গে তর্ক করতে গেলেও নারী লোভী, নারী উচ্চাকাঙ্ক্ষী!
এখন কেউ বেমক্কা তর্ক করতে পারেন, এমন স্বামী কি নেই, যিনি নিজের রক্ত ঘাম শ্রমের টাকা দিয়ে সম্পদ কিনে শুধু দলিলে নয়, নামফলকেও স্ত্রীর নাম লিখে দেন? আছেন, তাঁরাও যুগে যুগে ছিলেন, কিন্তু তাঁরাই মূল আলোচ্য হয়ে উঠতে পারেন না। কারণ, তাহলে এই দেশে ৫ শতাংশের কম জমির মালিকানা নারীর হতো না!
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা
আপাতত দেখা যাচ্ছে, অবর্ণনীয় গায়ের খাটনি দিয়ে ঘরের পাশাপাশি ব্যবসাও সামলে উঠে সেই রোজগারের একটা অংশও যদি নিজে সামলানোর অধিকার পাওয়া যায়, তাহলেই বিনিময়ে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা একরকম কিনে নেওয়া যায়। বাংলাদেশের লাখ লাখ ঘরের ভেতরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে বলে যা যা সামলাতে হয়, তা সামলে ঘর থেকে বের হয়ে আসতেই হবে।
বাইরের প্রতিকূল রাস্তা, নারীর জন্য নিষিদ্ধ বাজার, নির্মম গণপরিবহন সব জয় করে, হত্যা–ধর্ষণ, গায়ে হাত পড়ার আশঙ্কা, বাড়িতে ফিরলে স্বামীর গায়ে হাত তোলা—সব সামলে তবু সুযোগ পেলেই ব্যবসায় নেমে পড়তে হবে, রোজগারের কিছুটা আবার সবাইকে সামলে নিজের জন্য গুছিয়ে রাখতে হবে একদিন যাতে রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায়, নির্যাতন সামলে ওঠা না গেলে আর কোথাও আশ্রয় না মিললে নিজেকে রক্ষার কোনো ব্যবস্থা করা যায়, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, বৃদ্ধ শ্বশুর–শাশুড়ি, মা–বাবার চিকিৎসায় কাজে লাগানো যায়, স্বামীকে বিপদে–আপদে টাকা দিয়ে ব্যবসার পক্ষে আরও সামলে আনা যায়! আমি তো এ ছাড়া আপাতত কোনো পথ দেখি না!
কাজেই তত্ত্ব আমাকে যা–ই বলুক আর ফেসবুকে আমাদের শ্রেণির নারীরা কত ‘প্রিভিলেজড’, সে বিষয়ে যতই বক্তব্য শুনি না কেন, মেয়ের স্কুলের টিফিন, বাড়ির দুপুরের খাবার ঠিক করে, পাড়ার লন্ড্রিতে বিকাশ করে টাকা পাঠিয়ে সন্ধ্যার আগে যাতে বাড়ির লোকের দাওয়াতে যাওয়ার কাপড় বাড়িতে পৌঁছায়, সেসব কিছু ঠিক করে আপাতত আমি আমার সব প্রিভিলেজসহ অফিসের কাজে সকাল সাড়ে সাতটার প্লেনে উঠেছি।
ভাই রে, আপনি হয়তো হাসছেন আর বলছেন, এই যে প্রিভিলেজড উচ্চমধ্যবিত্ত মহিলা ঘরটাও নিজ হাতে সামলাতে পারে না, সব টাকা দিয়ে কেনে! আমি বলি, থাক যা পারি না তা পারি না, কৃতিত্ব চাই না, বাড়ির পুরুষ পেরে দেখাবে সে অপেক্ষা করার সুযোগও আমার নেই। বেলা বয়ে যায়! ‘ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা সামলা!’
নবনীতা চৌধুরী পরিচালক, জেন্ডার কর্মসূচি, ব্র্যাক