‘গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, কোনো যানবাহন নেই’

গণপরিবহন বন্ধ থাকায় গন্তব্যে যেতে পারেননি দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষজন। অনেকেই অপেক্ষায় থেকেছেন দিনভর। খালি ট্রাক পেলে তাতে চেপেও গন্তব্যে গেছেন অনেকে। আজ সকাল ১০টায় নগরের শাহআমানত সেতু এলাকায়সৌরভ দাশ

খাগড়াছড়ি সদরের বাসিন্দা তরুণ বিশ্বাস জানতেন না আজ রোববার সকাল ছয়টা থেকে চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। ব্যক্তিগত কাজে গতকাল চট্টগ্রাম নগরের বন্দর এলাকায় এসেছিলেন তিনি। আর আজ ফিরতে গিয়ে বিপাকে পড়েন।

সকাল আটটায় তিনি খাগড়াছড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে অক্সিজেন এলাকায় এসেছিলেন। কিন্তু কোনো বাস চলেনি। তাই বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সড়কে অপেক্ষা করছিলেন।

সকাল ১০টার দিকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেন চল্লিশোর্ধ্ব এ বেসরকারি চাকরিজীবী। তরুণ বলেন, এই গরমের মধ্যে প্রায় দুই ঘণ্টা সড়কে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো যানবাহন পাননি। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ভেঙে ভেঙে যাচ্ছেন অনেকে। এতে সময় দুই থেকে তিন ঘণ্টা বেশি লাগবে। খরচ বাড়বে ১ হাজার ২০০ টাকার মতো।

বাস চলাচল না করায় বিকল্প যানবাহনের খোঁজে ছিলেন যাত্রীরা। এ সময় কোনো মাইক্রোবাস দেখলে ছুটে গেছেন তাঁরা। আজ সকাল ১০টায় নগরের অক্সিজেন মোড়ে
জুয়েল শীল

তবে তিনি ট্রাক বা কারে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। শুধু তরুণ বিশ্বাস নন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে পাঁচ জেলার কয়েক হাজার যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েছেন।

চট্টগ্রাম নগর থেকে বিভিন্ন উপজেলা, কক্সবাজার জেলা, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার উদ্দেশে কোনো বাস ছেড়ে যাচ্ছে না। ওই সব এলাকা থেকে কোনো বাসও আসছে না। জেলার শহর এলাকায়ও চলছে না গণপরিবহন।

চারটি দাবিতে এ ধর্মঘট পালন করছেন গণপরিবহনের মালিক ও শ্রমিকেরা। মূলত গণপরিবহন মালিক ও শ্রমিকের বিরুদ্ধে দেওয়া মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার মালিক-শ্রমিকের মুক্তি, সড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করা, বিভিন্ন জায়গায় বাস আটকে রাখার প্রতিবাদ ও চুয়েটে পুড়িয়ে দেওয়া তিনটি বাসের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ধর্মঘট চলছে। গতকাল শনিবার মালিক ও শ্রমিকের যৌথ সভায় এসব দাবি তুলে ধরা হয়।

আজ সকাল আটটায় নগরের অক্সিজেন এলাকায় গিয়ে কয়েক শ যাত্রীকে গণপরিবহন ও দূরপাল্লার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। অক্সিজেন এলাকায় থেকে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার উদ্দেশে বাস ছাড়ে।

সরেজমিন দেখা যায়, শত শত যাত্রী অপেক্ষা করছেন যানবাহনের জন্য। পার্বত্য জেলা ছাড়াও চট্টগ্রামের কোনো উপজেলায় চলছে না যানবাহন। সিএনজিচালিত অটোরিকশা চললেও ভাড়া হাঁকছে তিন থেকে চার গুণ বেশি। অনেকে বাড়তি ভাড়া দিয়েই চলে গেছেন গন্তব্যে।

দুই ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন রাজু

রাজু চাকমার বাড়িও খাগড়াছড়ি সদরে। বন্ধুর বাসায় ঘুরতে এসে আটকে গেছেন তিনি। দুই ঘণ্টা ধরে অক্সিজেন এলাকায় ঘুরপাক খাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর কপালে কোনো যানবাহন জোটেনি। রাজু প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী এক ভোগান্তিতে পড়লাম। আগে জানলে খাগড়াছড়ি থেকে বের হতাম না। গরমে দাঁড়িয়ে আছি। কোনো গাড়ি নেই।’
রাজুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ফটিকছড়ি বিবিরহাট এলাকার বাসিন্দা মো. মনোয়ার। তিনি বলেন, ‘বাসে ভাড়া ৮০ টাকা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ১০০ টাকা। সে জায়গায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চাইছে ২০০ টাকা। না পারতে মানুষ উঠছে। এসব অরাজকতা দেখার যেন কেউ নেই।’

নগরেও নেই বাস, বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে অটোরিকশা

নগরের বিভিন্ন মোড়ে গিয়ে যাত্রীদের জটলা দেখা গেছে। মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, জিইসি এলাকায় শত শত মানুষ যানবাহনের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন সকালের দিকে। রিকশা, যাত্রী টানা মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বাড়তি ভাড়া দাবি করেছে বলে জানান যাত্রীরা।

রতন কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী এক মুসিবতে পড়লাম। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ২ নম্বর গেট থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত ভাড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকা। যানবাহনের সংকটের অজুহাতে চাইছে ২০০ টাকা।’

বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ সদস্যসচিব ও পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি মোহাম্মদ মুছা প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন মাসে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় লাইনম্যান, পরিবহনমালিক ও শ্রমিকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছে। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চাঁদাবাজির কথা বলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ কারণে ৪৮ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালিত হচ্ছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান মালিক-শ্রমিক যৌথ কমিটির আহ্বায়ক খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল শনিবার দুপুরে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সভা হয়। এতে মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার, মালিক-শ্রমিকদের মুক্তি, সড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করা, বিভিন্ন জায়গায় বাস আটকে রাখার প্রতিবাদ ও চুয়েটে পুড়িয়ে দেওয়া তিনটি বাসের ক্ষতিপূরণের দাবিতে কর্মবিরতিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এদিকে আজ পরিবহন মালিক সমিতির সদস্যদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হবে।

দুর্ভোগে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যাত্রীরা

যানবাহন না পেয়ে বেশির ভাগ যাত্রী তীব্র গরম উপেক্ষা করে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন। আজ সকালে অক্সিজেন মোড় এলাকায়
জুয়েল শীল

পারিবারিক কাজে চট্টগ্রাম থেকে লোহাগাড়া উপজেলা যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী। তবে প্রায় তিনটি স্থান ঘুরেও কোনো বাস পাননি। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে নগরের শাহ আমানত সেতু এলাকায় কথা হয় ইয়াকুব আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, দাবি আদায়ের অন্য উপায় আছে। আলোচনা করে সমাধানে আসা যেত। জনগণকে জিম্মি করে ভোগান্তিতে ফেলছেন তাঁরা।

সরেজমিনে নগরের বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কে বিভিন্ন জেলা-উপজেলাগামী বাস ছিল দুই থেকে তিনটি। সড়কে মাইক্রোবাস চলাচল করলেও তাতে ভাড়া তুলনামূলক বেশি। এদিকে শাহ আমানত সেতু মোড় এলাকায় অবস্থান নিতে দেখা গেছে শ্রমিকদের।

গণপরিবহন না থাকায় যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে সড়কে। নগরের চান্দগাঁও থানা এলাকা থেকে সাধারণত কক্সবাজারগামী বাস ছেড়ে যায়। তবে আজ কাউন্টারগুলোর সামনে কোনো বাস দেখা যায়নি। অধিকাংশ কাউন্টার ছিল বন্ধ।  

কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন যাত্রী বলেন, সকাল থেকে কোনো বাস নেই। কয়েকটি মাইক্রোবাস আসে কিছুক্ষণ পর পর। ভাড়া অনেক দ্বিগুণ চাওয়া হচ্ছে।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় কয়েকটি বাস আটকানোর খবর পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবীর বলেন, কর্মবিরতির সমর্থকেরা নগরে চলাচলকারী বাস আটকে রেখেছিল। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।