ছাড়ের প্রতিযোগিতায় কেউ ব্যবসা গোটাচ্ছে, কেউ পরিসর কমাচ্ছে

ফুড ডেলিভারি ব্যবসায় নতুন গ্রাহক ধরতে নানা ছাড়, ভাউচার, প্রোমো দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানগুলো
ছবি: সংগৃহীত

অনলাইনে খাবার অর্ডার এখন বাংলাদেশের শহুরে জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় এক দশক আগে দেশে এ সেবা শুরু হয়। বছর পাঁচেক ধরে বাজার বড় হচ্ছে।দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে অনেকের জন্যই ভরসা হয়ে ওঠে এই সেবা। কিন্তু এখন অতিরিক্ত ছাড়ের প্রতিযোগিতা, বিনিয়োগের অভাবসহ নানা কারণে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে সরে যাচ্ছে। কেউবা ব্যবসা ছোট করছেন। ফলে সেবাটি একচেটিয়া হয়ে পড়ছে।

গত বছরের অক্টোবর থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সহজ ফুড তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, কৌশলগত ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা ফুড ডেলিভারি সেবা বন্ধ করেছে।

আন্তর্জাতিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবার বাংলাদেশে তাদের ফুড ডেলিভারি সেবা ‘উবার ইটস’ চালু করেছিল। চালুর এক বছরের মাথায় ২০২০ সালে তারা বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়।

দেশের প্রথম ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান হাংরিনাকি ২০১৩ সালের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করে। ২০২১ সালের মার্চের আগপর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাতেই ছিল। সে বছরের মার্চে তাদের কিনে নেয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দারাজ। দারাজকে ২০১৮ সালে কিনে নেয় চীনা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবা।

হাংরিনাকি কেনার সময় দারাজ বলেছিল, ৬৪ জেলাতেই ফুড ডেলিভারি সেবা সম্প্রসারণ করা হবে।

কিন্তু এক বছর পার হতেই হাংরিনাকির সেবার আওতা ৩০ থেকে ১৫টি অঞ্চলে নামিয়ে আনা হয়। তার মধ্যে ঢাকায় ১৩টি, চট্টগ্রামে ২টি অঞ্চল রয়েছে।

হাংরিনাকির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাদের সেবাও কি বন্ধের পথে? জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে সম্ভাবনা এখন নেই। সেবার পরিসর ছোট করে মুনাফা করা যায় কি না, সে চেষ্টা করবে হাংরিনাকি।’

এভাবে এক এক করে প্রতিষ্ঠান সরে যাওয়া বা ব্যবসা ছোট করায় এ বাজার প্রতিযোগিতা হারাচ্ছে। ফলে বাজার একচেটিয়া হয়ে পড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ফুড ডেলিভারি সেবা খাতের পরিস্থিতি নিয়ে পাঠাও লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ফাহিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সেবার মান না বাড়িয়ে অনেকে গ্রাহক আকর্ষণে ছাড়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে। কিন্তু এ খাতে ব্যবসা বাড়াতে হলে গ্রাহকসেবার মান ও মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রেস্তোরাঁমালিকের ওপর আস্থা বাড়াতে হবে। ডেলিভারি এজেন্টদের নির্ভরযোগ্য আয়ের ওপর জোর দিতে হবে।

সারা দেশে এখন ব্যাপকভাবে ফুড ডেলিভারি সেবা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডা ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান পাঠাও। এ ছাড়া ছোট ছোট কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা নির্দিষ্ট পণ্যভিত্তিক ও এলাকাভিত্তিক সেবা দিচ্ছে।

ফুড ডেলিভারি সেবাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশে বছরে এ সেবার বাজার হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিদিন এক লাখের মতো অর্ডার হয়। ২০১৩ সালে চালু হওয়া ফুডপান্ডা এখন এ বাজারকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এই সেবা চলে প্রণোদনা বা ভর্তুকির ওপর। নতুন গ্রাহক ধরতে নানা ছাড়, ভাউচার, প্রোমো দেয় প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক ক্ষেত্রে এ ছাড় দেখেই অর্ডার করে গ্রাহক। এভাবে গ্রাহক ছাড় পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। একটি প্রতিষ্ঠান যখন ছাড় দিতে থাকে, তখন অন্য প্রতিষ্ঠানকেও প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। নয়তো সে গ্রাহক হারায়। এই ছাড় রেস্টুরেন্টগুলো দেয় না। ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো দেয়। ফলে এখানে ভর্তুকিতে বেশি অর্থ ঢালতে হয়। অতিরিক্ত ছাড় দিলে প্রচুর গ্রাহক আসে ঠিক, কিন্তু তাতে খরচ বেড়ে যায়। কোম্পানিগুলোর আয় মূলত ডেলিভারি চার্জ ও রেস্টুরেন্টগুলোর কমিশনের ওপর নির্ভর করে। এই কমিশন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ফুড ডেলিভারি ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে প্রয়োজনীয় লোকবলের পাশাপাশি প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশে গ্রাহকের যে মানসিকতা, তাতে এই ব্যবসায় লাভ করতে হলে বিনিয়োগের পাশাপাশি ধৈর্যও ধরতে হবে। এ ছাড়া বাজার বোঝার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, ফুড ডেলিভারি সেবায় সারা বিশ্বেই কমবেশি ছাড়ের প্রতিযোগিতায় চলে। বাংলাদেশে গ্রাহকদের একটি অংশ অনলাইনে খাবার অর্ডার করে শুধু ছাড় দেখেই। বলা যায়, এই মানসিকতাই বেশি। এ অবস্থায় বিশেষ করে দেশীয় ছোট প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। ফলে বাজার বড়দের দখলে চলে যায়।

দেশীয় ছোট ছোট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান যাতে মার্কেটে টিকে থাকতে পারে, সে জন্য ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন চলতি বছর একটি কমন প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে। ‘ওপেন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কমার্স’ নামে পরিচিত এই প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্টের মতো জায়ান্টের একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজারে জায়গা করে দেওয়া।

ভারতের এই মডেলের উদাহরণ টেনে ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে বাংলাদেশেও এমন মডেল চালু হতে পারে।’