সন্তান আর নাতি–নাতনির সান্নিধ্যে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চান সব পিতা-মাতা। যদিও অনেক মা–বাবার ভাগ্যে এমন সুযোগ জোটে না। সন্তান আলাদা হয়ে যায়। তখন পিতা-মাতা হয়ে যান নিঃসঙ্গ।
জীবনের শেষ পর্বে পিতা–মাতার খাওয়াদাওয়া, পোশাক, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রায় এক যুগ আগে ‘পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইন’ পাস করেছিল সরকার। যাতে বলা হয়েছিল, সক্ষম ও সামর্থ্যবান সন্তানেরা তাঁদের অভিভাবকদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করবেন। সন্তান ভরণপোষণ না দিলে আদালতে মামলা করতে পারবেন অভিভাবক।
কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ভরণপোষণ না দিয়ে অনেক সন্তানই উল্টো পিতা-মাতাকে নির্যাতন করেন। নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা থাকলেও বেশির ভাগ পিতা-মাতাই আদালতের দ্বারস্থ হন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সালিস-দরবার হয়। তবে তেমন ফল পাওয়া যায় না।
আবার আইনটি সম্পর্কেও অনেক অভিভাবক জানেন না। কারণ, আইন সম্পর্কে সরকারের দিক থেকে প্রচার-প্রচারণা তেমন নেই। ক্ষেত্রবিশেষে আইন জানলেও মামলা করতে চান না পিতা–মাতা। কারণ, এই আইনের অধীন অপরাধকে জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য বলা হয়েছে। তা ছাড়া পিতা-মাতাকে মানসিক নির্যাতন করা অপরাধ হিসেবে আইনে স্পষ্ট করা হয়নি।
অপরদিকে আইনটি পাস হওয়ার ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এর বিধিমালা হয়নি। ফলে আইনটি বাস্তবায়নে দেখা দিচ্ছে জটিলতা।
‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ’ আইনটি পাস হয়েছিল ২০১৩ সালে। এই আইনের আওতায় আদালতে কী ধরনের মামলা হচ্ছে, তা জানতে ছয়টি জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের তথ্য বিশ্লেষণ করেন প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা।
এ আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। বিশেষ করে কোনো নির্বাহী কর্তৃপক্ষ না থাকার কারণে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পাচ্ছেন না। আর মামলা–মোকদ্দমার জন্য যে আইনি সহায়তা পাওয়া দরকার, সেটি পাচ্ছেন না পিতা–মাতারা। ভুক্তভোগী একাধিক পিতা–মাতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আইন থাকলেও এর সুফল পাচ্ছেন না তাঁরা। ফলে তাঁদের মধ্যে একধরনের হতাশাবোধ তৈরি হচ্ছে।
তবে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান বলেন, ‘আইনটি ঠিকই আছে। অনেক ক্ষেত্রে পিতা–মাতাই তাঁদের সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চান না। কেউ যদি মামলা না করেন, তাহলে কী করার থাকে? আইনে তো বলাই আছে পিতা–মাতাকে মামলা করতে হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সন্তান যদি পিতা–মাতাকে ভরণপোষণ না দেন, নির্যাতন করেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের বৃদ্ধাশ্রম আছে। তাঁরা সেখানে আসতে পারেন।’
বিধিমালা না হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আশরাফ আলী খান বলেন, কেন বিধিমালা হয়নি, এ বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
বাদী যখন মা
গত ১৮ জুলাই শেরপুরের নকলা উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের বাসিন্দা মনিজা বেগম বাদী হয়ে ভরণপোষণ আইনে আমলি আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় মনিজা তাঁর দুই ছেলে, পুত্রবধূ, নাতিসহ ছয়জনকে আসামি করেন।
মনিজা বেগম অভিযোগ করেন, তিনি ও তাঁর স্বামী হাসমত আলী বয়স্ক মানুষ। তাঁদের আয়রোজগার নেই। সামান্য জমিজমা রয়েছে। এই জমিটুকু লিখে দেওয়ার জন্য তাঁর বড় ছেলে ছান্নান মিয়া, ছোট ছেলে শহিদুল ইসলামসহ দুই পুত্রবধূ ও দুই নাতি প্রায়ই চাপ দিতেন। এমনকি তাঁরা তাঁদের (পিতা–মাতা) কোনো ভরণপোষণও করেন না।
আদালতের পাশাপাশি ভুক্তভোগী পিতা–মাতার অভিযোগ আমলে নেওয়ার জন্য নির্বাহী কর্তৃপক্ষ গঠন করা উচিত। এই সংস্থার কাজ হবে ভুক্তভোগী পিতা–মাতার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।
গত ১৬ জুলাই নকলা উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের বাড়িতে মনিজা বেগমের স্বামী হাসমত আলী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় মনিজা তাঁর দুই ছেলে ছান্নান মিয়া ও শহিদুল ইসলামের কাছে তাঁদের বাবার চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা চান। ছেলেরা টাকাপয়সা না দিয়ে উল্টো মাকে মারধর করেন।
এ ঘটনার পর বিচার চেয়ে মনিজা বেগমের মামলায় আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। ২ আগস্ট মনিজার বড় ছেলে ছান্নান মিয়া শেরপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করেন। আদালত পিতা-মাতাকে ভরণপোষণ করার শর্তে ছান্নানকে জামিন দেন।
তথ্য বলছে, শেরপুরের বিভিন্ন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইনের আওতায় গত ছয় মাসে পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। আর বিচারাধীন রয়েছে ১১টি মামলা। পিতা-মাতার সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে সন্তানেরা ভরণপোষণ না দেওয়ায় এসব মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলারই বাদী ভুক্তভোগী মা।
ফেনীতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গত ছয় মাসে ভরণপোষণ আইনে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার আরজিতে মা–বাবার শেষ জীবনের নিঃসঙ্গতা, অসুস্থতা, চিকিৎসা সমস্যা, খাওয়া–পরার সমস্যার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।
ফেনীর সোনাগাজীর রাজাপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী সুফিয়া খাতুন গত ১৭ জুলাই আদালতে ভরণপোষণ আইনের ৫–এর (১) ধারায় মামলা করেন। দুজনের অভিযোগ, সন্তান তাঁদের ভরণপোষণ দেন না। উল্টো সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য প্রায় সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন।
তবে এ মামলাটির কিছু অপব্যবহারের নজিরও আছে। ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুরের আনোয়ারা বেগমের অভিযোগে জানা যায়, তাঁর পাঁচ ছেলে। এর মধ্যে বড় ছেলে ও ছোট ছেলে তাঁকে দেখাশোনা করেন। অন্য তিন ছেলে তাঁদের স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকেন। তাঁরা ভালো অবস্থানে আছেন। তাঁরা মায়ের ভরণপোষণ, ওষুধ কেনার টাকাপয়সা দেন না। উল্টো তাঁকে মানসিক নির্যাতন করেন। এ মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন বলে আদালত সূত্র জানায়।
জানতে চাইলে আনোয়ারার এক ছেলে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ছোট ভাই মাকে ভুল বুঝিয়ে এ মামলা করিয়েছেন। এখন তাঁদের নিজেদের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে। সব ভাই সমানভাবে মাকে দেখাশোনা, ভরণপোষণ ও ওষুধপথ্যের টাকা দিয়ে থাকেন।
ভরণপোষণ না দেওয়া ও নির্যাতন করায় নারায়ণগঞ্জে ভরণপোষণ আইনে মামলা হয়েছে ১০টি। রাজশাহী, হবিগঞ্জ ও কুমিল্লায় মামলার সংখ্যা ৫ থেকে ১০–এর মধ্যে।
আইনের সংস্কার চান অনেকেই
বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলেছেন, পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইনে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন ৬ নম্বর ধারায় অপরাধকে জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য বলা হয়েছে। ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়, অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। তাঁরা বলছেন, এই আইনে সাজা কম। ফলে অভিভাবকেরা মামলা করতে আগ্রহী হন না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, অভিযোগ নিয়ে গেলেও পুলিশও খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। আইনটি সংশোধন করে জামিন অযোগ্য করা, কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি অর্থদণ্ড বাড়ানোর পরামর্শ দেন তাঁরা।
বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইনে বিস্তারিত কিছু নেই, যা সাধারণত বিধিমালায় থাকে। এখন পর্যন্ত বিধিমালা না হওয়ায় মামলা নিষ্পত্তি করতে সমস্যা হচ্ছে।
মামলাটি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভরণপোষণ না পেয়েও অধিকাংশ পিতা–মাতা সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করতে চান না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সমাজে বহু পিতা-মাতা ভরণপোষণ পাচ্ছেন না, দিনের পর দিন মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ মানসিক নির্যাতন আইনে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আইনে এটিকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আবার এই আইনে সাজার পরিমাণও একেবারেই কম।’
সাবেক এই বিচারক আরও বলেন, আদালতের পাশাপাশি ভুক্তভোগী পিতা–মাতার অভিযোগ আমলে নেওয়ার জন্য নির্বাহী কর্তৃপক্ষ গঠন করা উচিত। এই সংস্থার কাজ হবে ভুক্তভোগী পিতা–মাতার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।
[প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী, প্রতিনিধি, ফেনী ও শেরপুর]