নভেরার অজানা জীবন

গ্রেগোয়ার দো ব্রুন্স কিংবদন্তি ভাস্কর নভেরা আহমেদের স্বামী। ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে নভেরা সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছিলেন। জাভেদ হুসেন তার বাংলা অনুবাদ করেছেন।

নভেরা আহমেদ

নভেরা আহমেদের বাবা ছিলেন বেশ প্রগতিশীল মানুষ। বাবা তাঁর সব মেয়ের জন্যই সবচেয়ে ভালো লেখাপড়া নিশ্চিত করেছিলেন। ওরা ছিল চার বোন—ঝুনু, পেয়ারে, নভেরা আর টুকু। প্রত্যেকেই সেরা শিক্ষা পেয়েছিলেন। গান শিখেছেন, নাচ শিখেছেন, ছবি আঁকা শিখেছেন। সবই বাড়িতে আসা শিক্ষকের কাছে। সে সময়ে এটি ছিল ব্যতিক্রমী এক পরিবার, বিশেষ করে যখন সমাজে মেয়েদের শিক্ষা ও সৃজনশীলতার প্রতি এতটা গুরুত্ব দেওয়া হতো না।

ছোটবেলা থেকেই নভেরা নাচ ভালোবাসত। তার একমাত্র অনুপ্রেরণা ছিলেন উদয়শঙ্কর। তখন বিভিন্ন রকম সর্বভারতীয় নৃত্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো, বিশেষ করে কলকাতায়। মাত্র ছয় বছর বয়সে নভেরা এমনই এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। উদয়শঙ্করের শৈলীতে নৃত্য পরিবেশন করে জিতেছিল সোনার মেডেল।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তুমি কীভাবে সোনার মেডেল জিতলে?’

নভেরা হেসে বলল, ‘খুব সহজে।’ তারপর একটা মজার কাহিনি বলেছিল, ‘নাচের সময় আমার পায়ের ঘুঙুর পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। আমি নাচ থামালাম না। বরং তৎক্ষণাৎ কিছু নতুন ভঙ্গিমা করে নাচের মধ্যেই ঘুঙুর তুলে নিলাম। এটাই সবাইকে মুগ্ধ করল। বিচারকেরা তো অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন।‘

নভেরার পৈতৃক বাড়ি, চট্টগ্রাম

নভেরার জীবনপ্রবাহ কিন্তু সহজ ছিল না। সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, তার বিয়ে ঠিক হয় বাবার এক সহকর্মীর ছেলের সঙ্গে। কিন্তু নভেরা বিয়ে করতে রাজি হলো না। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল, ‘আমি বিয়ে করতে চাই না!’

তার বাবা বিস্মিত হলেন। নভেরা বরাবরই, যাকে বলে অবাধ্য ও অদম্য। সবাই ওকে ডাকত বুনো। বুনো এক মেয়ে। বাবা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু নভেরার এককথা, ‘না, আমি বিয়ে করতে চাই না। আমি ভাস্কর্য তৈরি করব। ভাস্কর হব।’

নভেরার বয়স তখন খুব অল্প। এত কম বয়সের একটি মেয়ে যে স্পষ্ট ভাষায় তার বাবাকে বলে দিতে পারে যে সে বিয়ে নয়, বরং ভাস্কর্য নিয়ে জীবন কাটাতে চায়—এ তো তখনকার দিনে অকল্পনীয় এক ঘটনা!

স্বাভাবিকভাবেই বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। প্রথমে তিনি আপত্তি করলেন। নভেরা সব ভাঙচুর শুরু করে দিল, একেবারে বুনো বাঘের মতো হিংস্র হয়ে। ওকে থামানোর মতো সাহস কারও ছিল না। মেয়ের একগুঁয়েমি ও সাহস দেখে বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে। তোমাকে আমি লন্ডনে পাঠাব। তবে সেখানে তোমাকে আইন পড়তে হবে।’

নভেরার বাবা সৈয়দ আহমেদ

সে সময়টি ছিল ১৯৫০ বা ১৯৫১ সাল। নভেরার বড় বোনদের একজন পেয়ারে লন্ডনে থাকতেন, স্বামীর সঙ্গে। নভেরা লন্ডনে গেলেন, আইন পড়বেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। সেখানে গিয়ে নভেরা অবশ্য আইন পড়ার ধারেকাছেও গেল না। বেছে নিল একেবারে অন্য পথ। আইন পড়ার বদলে সে সিটি অ্যান্ড গিল্ডসে ভর্তি হলো ভাস্কর্য শেখার জন্য।

খবর পেয়ে নভেরার বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। টাকাপয়সা পাঠানো একেবারে বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু নভেরা তো থেমে থাকার মানুষ নয়। থেমে থাকলও না। নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিল। হয়ে উঠল একজন শিল্পী, এক অদম্য প্রাণ।

এরপর তার জীবনে এল এক নতুন মোড়। সে নাজির আহমেদের সঙ্গে দেখা করল। নাজির ছিলেন হামিদুর রাহমানের ভাই। নাজির তাকে বললেন, ‘তুমি যদি ভাস্কর্য করতে চাও, তাহলে তো অন্তত একটা ডিপ্লোমা লাগবে! কোথাও তো তোমাকে ভর্তি হতে হবে।’ নভেরা বলল, ঠিক আছে।

নভেরার মা গুলশান বেগম

নাজির আহমেদ তাকে নিয়ে গেলেন ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টে। তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর। এত অল্প বয়সেই সে ভর্তি হলো ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টে। সেখানে দেখা হলো প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান ভাস্কর্য শিক্ষকের সঙ্গে। তাঁর সামনে গিয়ে নভেরা বলল, ‘আমি ভাস্কর্য শিখতে চাই।’

তিনি হাসলেন। কথাটা যে বলছে, সে খুবই ছোট একটা মেয়ে। বললেন, ‘তুমি ভাস্কর্য শিখতে চাও? তাহলে কিছু কাদামাটি নিয়ে এসো।’

নভেরার বোন কুমুম হক ঝুনু

নভেরা কাদামাটি নিয়ে এসে সঙ্গে সঙ্গে একটি আকৃতি তৈরি করলেন। শিক্ষক দেখে বুঝলেন, এই মেয়ের প্রতিভা আছে। তাকে স্কুলে ভর্তি করে নেওয়া হলো।

নভেরা এখানে কোর্স শেষ করল। এরপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য চলে গেল ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। সেখানেও শিল্প শেখার নতুন দিগন্ত খুলে গেল তার সামনে। লন্ডনে যে ধরনের ভাস্কর্য শেখানো হতো, ফ্লোরেন্সে সেটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এরপর সে আরও শেখার জন্য গেল ভিয়েনায়।

ফ্লোরেন্সে থাকাকালে নভেরা ভেন্তিরিনো ভেনতুরির শিক্ষার্থী হন। তিনি তখন ইতালির সেরা চার–পাঁচজন ভাস্করের একজন। তাঁর কাছ থেকে সে অনেক গোপন কৌশল শেখে। পড়াশোনা শেষে নভেরার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সে রাজি হয়নি। তার মন পড়ে ছিল নিজের জন্মভূমিতে।

নভেরার বোন শরিফা আলম পেয়ারে

নভেরা ফিরে এল ঢাকায়। কিন্তু ফিরে এসে দেখল এক শূন্যতা। কোথাও কোনো ভালো কর্মশালা নেই, মার্বেল বা ঢালাইয়ের কারখানাও নেই। কী করবেন? কোথায় শুরু করবেন? তখন বাবাই তার পাশে দাঁড়ালেন। নভেরা বাবাকে খুব ভালোবাসত। বাবাই তাকে বললেন, ‘তুমি সিমেন্ট দিয়েই কাজ শুরু করো না কেন?’

নভেরা তা-ই শুরু করল। প্রথম ভাস্কর্য তৈরি করল সে সিমেন্ট দিয়ে। এরপর এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা তার জীবন বদলে দিল।

নভেরার বোন তাজিয়া টুকু

সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন চলছিল। মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্র আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সরকার তাঁদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করতে চাইল। অথচ দেশে তখন পেশাদার কোনো ভাস্কর নেই। শুধু নভেরাই ছিল, যার ছিল আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও ডিপ্লোমা।

একজন স্থপতি নভেরার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নভেরার কাছে তখন ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইন অ্যান্ড স্কাল্পচার ছিল। সরকার তাকে সেই শহীদ মিনার নির্মাণের দায়িত্ব দিল। সে কাজ শুরু করে দিল। সহকারী হিসেবে নিল হামিদুর রাহমানকে, মূলত ফ্রেস্কো আর স্টেইনড গ্লাসের কাজ করার জন্য।

ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস, ১৯৫২

নভেরাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কীভাবে সে এই শহীদ মিনার তৈরির অনুপ্রেরণা পেল। সে তখন হাতের একটি বিশেষ মুদ্রা দেখাল—আশীর্বাদের মুদ্রা। একটি হাত, যা জনতাকে আশীর্বাদ দিচ্ছে। তাই এই শহীদ মিনারে পাঁচটি আঙুল রয়েছে। এটি সেই জনতার জন্য আশীর্বাদের প্রতীক, যারা এই শহীদ মিনারে আসবে। পড়ে আমি পড়েছি, শহীদ মিনারকে মা ও সন্তানের প্রতীক বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু আসলে এটি মা আর সন্তানের ভাস্কর্য নয়। যদি সেটাই হতো, তাহলে সেখানে পাঁচটি আঙুল থাকত না, বরং দুটি বা তিনটি থাকত।

এর প্রায় পরপরই ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। নভেরাকে তখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ বাদ দিয়ে সেখান থেকে সরে আসতে হয়। সে চলে যায় লাহোরে। তার কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। সে সবকিছু রেখে চলে যায়। আর হামিদুর রাহমান হয়ে যান তার সহকারী থেকে শহীদ মিনার প্রকল্পের প্রধান। তিনি এই প্রকল্পটি সম্পন্ন করেন এবং অনেকেই মনে করে, এটি তাঁরই সৃষ্টি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এই প্রকল্পের আসল স্রষ্টা নভেরা। সে-ই মূল ধারণাটি দিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত এটি সম্পূর্ণ করতে পারেনি।

নৃত্যশিল্পী নভেরা

নভেরা কখনো বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির চিন্তা করত না। এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছিল সে। তার কাছে রং, রূপ, শিল্পই ছিল সব। সে ছিল অন্য রকম মানুষ।

এরপর নভেরা ফ্রান্সে চলে যায়। এর আগে সে লাহোরে গিয়েছিল। সেখানে কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সঙ্গে তার দেখা হয়। ফয়েজ তার অনুরাগী ছিলেন এবং তাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। ফয়েজের সহযোগিতায় নভেরা পাকিস্তানে বেশ কিছু শিল্পকর্ম বিক্রি করতে সক্ষম হয়। ফয়েজ তাকে এমন কিছু ধনী ক্রেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যাঁরা তার শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতে আগ্রহী ছিলেন।

নিজের ভাস্কর্যে শিল্পী নভেরার হস্তস্পর্শ

পরে নভেরা বাংলাদেশে ফিরে এসে ১০০ ভাস্কর্যের প্রদর্শনী আয়োজন করে। এর মধ্যেই তার বাবা মারা যায়। এটি ছিল তার জন্য বড় এক আঘাত। বাবার মৃত্যুর সময় সে ছিল হংকংয়ে। দ্রুত সে দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু ভুল ফ্লাইটে উঠে আবার হংকংয়ে ফিরে যায়। এ কারণে বাবার শেষকৃত্যে সে উপস্থিত থাকতে পারেনি। ব্যাপারটা তাকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল।

এরপর নভেরার মা ক্যানসারে আক্রান্ত হন। পরিবারের সবাই ধরে নিয়েছিল যে ওর মা বাঁচবেনই না। মায়ের একরকম প্রায় দাফনের প্রস্তুতিই চলছিল। কিন্তু নভেরা এটা মানতে চায়নি। সে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ছয় মাস তাঁর পাশে থেকে সেবা করে। সে বিছানার পাশে মেঝেতে ঘুমাত। মায়ের হাত ধরে থাকত। মা-বাবাকে সে অসম্ভব ভালোবাসত। হয়তো সে পরিবারের আদরের সন্তান ছিল। অন্য সন্তানেরা সম্ভবত এটা নিয়ে কিছুটা ঈর্ষাতুর ছিল।

নভেরা আহমেদের আঁকা শহীদ মিনারের নকশা

নভেরার মা শেষ পর্যন্ত ভালো হয়ে ওঠেন। মা তাকে বলেন, ‘এখানে না থেকে তুমি প্যারিস চলে যাও।’ মায়ের এই কথাটি ছিল বিস্ময়কর। চট্টগ্রামের মতো জায়গা থেকে একজন মা কীভাবে তার মেয়েকে প্যারিসে যাওয়ার পরামর্শ দেন? নভেরার মা খুব বুদ্ধিমতী ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই জায়গা তাঁর মেয়ের উপযুক্ত নয়। এটি সত্যিই বিরল এক ঘটনা।

নভেরা লন্ডনে চলে যেতে পারত, কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল প্যারিসই তার জন্য সঠিক জায়গা। ১৯৬৩ সালের বড়দিনের সময় সে প্যারিসে গিয়ে পৌঁছায়। তারপর সে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে যায়। আমার কাকার একটি গ্যালারি ছিল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের কাছাকাছি। হঠাৎ আমি দেখি, একজন শ্যামা নারী কালো শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিস্মিত হয়ে নিজেকে বললাম, এই নারী কে? ঠিক তখনই যেন ভেতরের এক কণ্ঠস্বর আমাকে বলল, ‘এই নারীই তোমার জীবনের সঠিক মানুষ’। হ্যাঁ, তার মধ্যে সত্যিই কিছু ছিল। এ যেন নির্ধারিতই ছিল যে আমাদের সাক্ষাৎ হবেই।

ব্যাংককে গ্রেগোয়ার, ১৯৬৯

আরেক দিন আমি তাকে দেখলাম। এবার তার সঙ্গে ছিল এক আমেরিকান বন্ধু, নাম কোলেট। সে এসেছিল নিউ অরলিয়েন্স থেকে। তারা একটি ক্যাফেতে গেল। কোলেট তখন তাকে ফরাসি শেখাচ্ছে। তবে নিজে ফরাসি না হওয়ায় তার কিছু ভুল হচ্ছিল। আমি বললাম, ‘এটা এভাবে নয়, ওভাবে বলা উচিত।’ তারা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’ আমি বললাম, ‘আমি ফরাসি, তাই ভুলটা ধরতে পারছি।’ এভাবেই আমাদের পরিচয় হলো। তারপর শুরু হলো এক রোমান্স। সেই দিকটা নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।

নভেরা ও গ্রেগোয়ার

এরপর নভেরা চলে গেল হংকং। সেখানে ও ছিল পুরো একটা বছর। আমি তখন প্যারিসে। একটি মিউজিয়ামের জন্য কী একটা কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। ১৯৬৬ সালে নভেরা আবার ফিরে এল। ১৯৬৬-৬৭ সালে সে তার প্রথম ধাতব ভাস্কর্য তৈরি করল। সেটির একটি অংশ তৈরি হয়েছিল প্যারিসে, বাকিটা সুইজারল্যান্ডের মন্ট্রোয়।

নভেরা অনেক ভ্রমণ করত। মন্ট্রোয় একটি অপূর্ব জায়গা। পাহাড়ের ছায়ায় লেকের পাশে। সেখান থেকে সে আবার হংকং ফিরে গেল। তারপর গেল ব্যাংককে। আমি তখন ছিলাম নিউইয়র্কে। তাকে টেলিগ্রাম পাঠালাম, ‘আমি ব্যাংককে তোমার কাছে আসছি।’ নিউইয়র্ক থেকে আমি উড়োজাহাজে করে ব্যাংককে রওনা দিলাম।

এটা ছিল নিখাদ রোমান্স। পথে থামলাম জেনেভা, নিউইয়র্ক, জেনেভা। এরপর বোম্বে হয়ে ব্যাংকক। সেখানে ঠিক হলো, ব্যাংককে একটি প্রদর্শনী করা হবে। তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে। আমেরিকা ওই অঞ্চলে বোমাবর্ষণ করছিল। নভেরা সে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছিল। সে ভাঙা যুদ্ধবিমান থেকে পাওয়া ধাতু দিয়ে পাঁচ-ছয়টি ভাস্কর্য তৈরি করল।

‘উপবিষ্ট রমণী’, শিল্পী: নভেরা আহমেদ

এই কাজের ফলে সে আর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেল না। আমি তাকে সান ফ্রান্সিসকো নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মার্কিন কনস্যুলেট তাকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে তৈরি এই ভাস্কর্যগুলো আমেরিকায় প্রদর্শিত হোক, সেটা তারা চায়নি।

এরপর আমি গেলাম তাইপেই, চীনের ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়ামে। সেখানে আমরা চীনা চিত্রকলা, বিশেষ করে স্ক্রল পেইন্টিং দেখলাম। নভেরা ঠিক করল, সে চীনা স্ক্রলের ওপর আঁকবে। সে স্প্রে পেইন্ট ব্যবহার করতে শুরু করল, ঠিক যেভাবে এখনকার স্ট্রিট আর্টিস্টরা করে। সম্ভবত সে-ই প্রথম শিল্পীদের একজন, যারা স্প্রে পেইন্ট ব্যবহার করে ছবি আঁকতে শুরু করেছিল।

‘মা ও শিশু’, ১৯৫৮, শিল্পী: নভেরা আহমেদ

নভেরার পদ্ধতি ছিল ব্যতিক্রমী। সে কাগজ কেটে ছাঁচ বানাত, তারপর স্প্রে করত। এরপর সেই ছাঁচ সরিয়ে নতুন একটি ডিজাইন তৈরি করত। এতে কাজ দ্রুত হতো, শুকাতেও সময় লাগত না। পদ্ধতিটি নভেরার খুব পছন্দ হয়ে গেল।

প্যারিসে ও ব্যাংককে সে অনেক স্প্রে পেইন্টিং করেছিল। এতে কিছুটা ভাস্কর্যের মতো অনুভূতি পাওয়া যেত। কারণ, এখানে কিছুটা তৈরি করার ব্যাপার ছিল। কিছুটা ছাঁচ কেটে কাজ করতে হতো। তারপর তা স্ক্রলে ফুটিয়ে তুলতে হতো।

নভেরার ভাস্কর্য: ১

এ ছাড়া সে বিশাল আকারের বাগানের ভাস্কর্য তৈরি করেছিল। এগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। নগর-পরিকল্পনার অংশ হিসেবেও তার কাজের স্বীকৃতি মিলেছিল।

দুর্ভাগ্যবশত নভেরার বহু কাজ হারিয়ে গেছে। গুটিয়ে রাখা যেত বলে কিছু স্ক্রল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, তবে বড় কাজগুলো হারিয়ে গেছে। কিছু কাজ পাকিস্তানের দূতাবাসে ছিল, কিছু হয়তো অস্ট্রেলিয়া বা সিঙ্গাপুরে পৌঁছেছিল। সাংবাদিক এস এম আলীর কাছেও নভেরার কিছু চিত্রকর্ম ছিল।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, নভেরা কখনোই বস্তুগত বিষয়ে চিন্তা করত না। তার কাছে শিল্পই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে তুলনায় বাকি সবকিছু গৌণ।

ব্যাংকক থেকে নভেরা আবার প্যারিসে ফিরে গেল। আমি ভেবেছিলাম, এবার বুঝি চিরতরে চলে গেল। তখন আমি জাপানে। একদিন আমি তার কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম পেলাম, ‘তাড়াতাড়ি চলে আসো।’

তক্ষুনি আমি নারিতা বিমানবন্দর থেকে উড়াল দিলাম। ১৯৭১ সালের শুরুতে আবার এলাম প্যারিসে। আমাদের থাকতে হবে, কাজ করতে হবে। আমরা একটি বাড়ি ভাড়া নিলাম। শুরু হলো ১৯৭৩ সালের প্রদর্শনীর প্রস্তুতি।

নভেরার ভাস্কর্য: ২

১৯৭২ সালে নভেরা দুটি বিড়ালের ভাস্কর্য করেছিল। আমাদের প্রদর্শনী হলো স্বনামধন্য একটি গ্যালারিতে। তখনকার শিল্পীদের অনেকেই স্প্রে পেইন্টিং ঠিক বুঝতে পারছিল না। বিশেষ করে ‘কোবরা গ্রুপ’-এর চিত্রশিল্পীরা একে ঠিক গ্রহণ করতে পারছিল না। তারা তখনো তুলি ব্যবহার করত, যুক্ত ছিল ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলার সঙ্গে। স্প্রে দিয়ে আঁকাকে তারা স্বীকৃতি দিতে পারছিল না।

১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটল। এতে নভেরা মারাত্মকভাবে আহত হলো। পুরো একটা বছর তাকে হাসপাতালে কাটাতে হলো। এই সময়ে নভেরা কোনো কাজ করতে পারেনি। কোনো চিত্র আঁকেনি, ভাস্কর্য তৈরি করেনি। সবকিছু থেমে গেল।

নিজের স্টুডিওতে নভেরা, আনুমানিক ১৯৫৯–৬০

এরপর আমরা অনেক ভ্রমণ করেছি। আমরা ভেনিস গেলাম। ভেনিস নিয়ে আমি একটি বই লিখছিলাম বলে সেখানে আমাদের তিন মাস কাটাতে হলো। ভেনিস ছিল সত্যিকারের রোমান্টিক শহর, যা আমাদের মুগ্ধ করেছিল। তবে আমি শুধু রোমান্সে মগ্ন ছিলাম না, কাজও করছিলাম। আমরা আকাদেমিয়াসহ বিভিন্ন বিখ্যাত জাদুঘর ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম।

কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (১৯১১–১৯৮৪)

ভেনিসে আমাদের জন্য একটা ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল। মিউজিয়ামের কর্মীরা আমাদের এতটাই ভালোবেসেছিল যে আমরা প্যারিস ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলে তারা আমাদের বিদায় জানাতে বিশেষ একটি নৈশভোজ আয়োজন করেছিল।

১৯৮৪ সালে আমরা ভারত গেলাম। রাজস্থান তার বিশেষ পছন্দের জায়গা ছিল। আমরা কাশ্মীর, দিল্লি, রাজস্থান ঘুরে বেড়ালাম। তখন মার্চ মাস। কাশ্মীরে তীব্র ঠান্ডা ছিল। এর আগে ১৯৬০-এর দশকেও সে ভারতে গিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে আবার গিয়েছিল। তবে এবার আমরা আরও দক্ষিণে যাত্রা করলাম—মহাবলিপুরম, মাদ্রাজ, বোম্বে, দিল্লি, আগ্রা। জায়গাগুলো ঘুরলাম। প্রতিটি জায়গাই নভেরার জন্য ছিল এক নতুন অনুপ্রেরণার উৎস।

এরপর পুরো দশ বছর আমরা ইউরোপ ভ্রমণ করলাম—গ্রিস, তুরস্ক, ইতালি, ভেনিস। বছরে অন্তত দুবার আমরা ভেনিস যেতাম। প্যারিসের পর ভেনিস যেন আমাদের দ্বিতীয় শহর হয়ে উঠেছিল।

শিল্পী হামিদুর রাহমান (১৯২৮–১৯৮৮)

১৯৮৪ সালে নভেরা আমাকে এক চরম সিদ্ধান্তের মুখে দাঁড় করাল। সে বলল, ‘আমি আর শহরে থাকতে চাই না, গ্রামে থাকতে চাই। তোমার হাতে মাত্র পনেরো দিন। এর মধ্যে আমার জন্য একটা বাড়ি খুঁজে বের করতে হবে।’

আমি তো একেবারে হতবাক! কীভাবে এত অল্প সময়ে পছন্দমতো একটা জায়গা খুঁজে পাব? কপাল ভালো, সুন্দর একটা জায়গা আমি খুঁজে পেলাম—সিন নদীর ধারে, গভীর অরণ্যের মধ্যে, একটা পাহাড়ের পাশে। দেখেই মনে হলো, এটাই ঠিক জায়গা! তবে নভেরা প্রথমে খুব উৎসাহ দেখাল না। বরং বাড়ির আগের মালিক, এক বয়স্ক নারী, তাকে বললেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এখানে গাছপালার ফাঁক দিয়ে জলধারায় যে সূর্যাস্ত দেখা যায়, তা অপূর্ব!

বাড়িটা সত্যিই যেন আমাদের জন্যই নির্ধারিত ছিল। এটি ছিল মূলত একটি শিকার–কুটির। আমি প্রথম তলাকে আর্ট স্টুডিও বানালাম। নিচের তলায় আমরা থাকতাম।

নভেরা হঠাৎ করেই আবার সৃষ্টিকর্মে মেতে উঠল—তুলির আঁচড়ে, ভাস্কর্যে। আবার সবকিছু ফিরে এল। তবে প্রচুর কাজ সে কখনোই করত না। চারপাশের পরিবেশ যখন তাকে কাজে অনুপ্রাণিত করত, তখনই সে শিল্পরচনায় নিবিষ্ট হতো। এই জায়গাটি তাকে সে রকমই একটা অনুভূতি দিয়েছিল।

সাংবাদিক এস এম আলী (১৯২৮–১৯৯৩)

তার চিত্রকর্ম ছিল অন্য রকম, একেবারে তার নিজস্ব। একবার এক শিল্পীবন্ধুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, নভেরার শিল্পকর্ম কেমন? সে বলল, ‘নভেরার নিজস্ব একটি জগৎ আছে। তার একটি চিত্রকর্ম দেখলেই বুঝতে পারবে, এটা নভেরার কাজ।’

নভেরার ছবির রং অপূর্ব। ভাস্করের মতো তার আঁকাগুলো কখনোই সমতল ছিল না—সেগুলোতে যেন গভীরতা, আকার আর গঠন ছিল। ছবিগুলো সব সময় রহস্যময় ও আধ্যাত্মিক একটি অনুভূতি দিত। সারা জীবনে নভেরা মাত্র ৫০টির মতো ছবি এঁকেছিল। সংখ্যায় কম হলেও প্রতিটি চিত্র ছিল একেকটি জানালা, যার মধ্য দিয়ে তার অন্তর্জগৎ দেখা যেত।

‘ইকারুস’ ভাস্কর্যের পাশে শিল্পী নভেরা

তার আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে ‘কক্সবাজার’ ছিল অসম্ভব মনোমুগ্ধকর এক চিত্র। ‘হিউম্যানিটি’ ছিল বিশাল আকৃতির ছবি। ‘চাঁদের আলোয় পাখি’ অনন্য এক সৃষ্টি। আরেকটি ছবি ‘তিনজন নারী’—আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃত পাখিদের দেখে নারীরা যেন বলছে, দেখো কী হয়েছে!

নভেরার কাজ এত শক্তিশালী ছিল যে একবার এক দর্শক একটি ছবির সামনে ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন। পরে আমাকে বললেন, ‘এসব ছবি নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কোনো অধিকার আপনার নেই। এগুলো শুধু আপনার স্ত্রীর নয়, মানুষের সম্পদ। এগুলো জাদুঘরে থাকা উচিত।’

তার ভাস্কর্যও একই রকম মনোমুগ্ধকর ছিল। নভেরা প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ অনুভব করত, প্রকৃতির স্পন্দন বুঝত। সে কখনোই টাকার জন্য ছবি আঁকত না বা ভাস্কর্য গড়ত না।

১৯৭৪ সালের শেষ প্রদর্শনীতে আমি সবকিছু বিক্রি করতে পারতাম। অনেকে কিনতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, ‘না, এসব বিক্রির জন্য নয়। এগুলো শিল্পের জন্য।’

কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাহক, বিশেষ করে একজন বিশিষ্ট নারী সংগ্রাহক, নভেরার অনেক কাজ কিনতে চেয়েছিলেন। আমি বিক্রি করতে চাইনি। আমি সব কাজ একসঙ্গে রাখতে চেয়েছিলাম। কারণ, কিছু কাজ যদি একটি জাদুঘরে থাকে, আর কিছু অন্য জাদুঘরে বা ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের মধ্যে ছড়িয়ে যায়, তাহলে তার কাজের সামগ্রিকতা আর ধরে রাখা যাবে না। আমি চাইনি তার শিল্পকর্ম নিয়ে কোনো রকম বাণিজ্যিক জল্পনা হোক। নভেরাও তা চাইত না।

নভেরা আহমেদ, ১৯৭৫

নভেরা সাধারণ অর্থে কোনো প্রচলিত শিল্পী ছিল না। সে ছিল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নভেরা জানত সে কে এবং কী করছে। তার জীবন ছিল কষ্টে ভরা, কিন্তু সে ছিল অসাধারণ সাহসী। যা-ই হোক, তার সামনে এসে দাঁড়ালে সে লড়াই করতে জানত।

নভেরার মৃত্যুর পর ওর শিল্পকর্মগুলো আমি এক জায়গায় সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একসঙ্গে তার কাজ দেখতে পারে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘La Roche-Guyon’ নামে একটি জায়গার কাছে জাদুঘর তৈরি করব। সে উদ্দেশ্যে আমি সিন নদীর তীরে একটি বাড়ি কিনলাম। জায়গাটি সত্যিই মনোরম—নদীর ধারে, দিগন্তজোড়া সুন্দর দৃশ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নভেরা বেঁচে থাকলে জায়গাটা ওর পছন্দ হতো। ওর কাজগুলোর জন্য এমন একটি স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলাই আমার লক্ষ্য।

নভেরার ভাস্কর্যের কথা বলি। প্রথমে প্যারিসের ভাস্কর্য। সেগুলো এখানকার ভাস্কর্যগুলোর চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। কারণ, প্যারিসে গিয়ে সে স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে মিশেছিল। লন্ডন থেকে আসার পর সে ব্রিটিশ শিল্পী হেনরি মুরের কাজ দেখে মুগ্ধ হলো। কিন্তু প্যারিসে সে সেজারের মতো শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হয়। তার কাজের ধরন বদলাতে থাকে। কাজগুলো আর আগের মতো থাকল না।

রাজস্থানে হাতির পিঠে, ১৯৮৪

নভেরা প্রথমে ধাতুর কাজ শুরু করল, ঢালাই দিয়ে। গরম ধাতু দিয়ে কীভাবে মডেলিং করা যায়, সে তার একটি নতুন কৌশল বের করল। গলিত ধাতু দিয়ে অনেক বড় কাঠামো নিয়ে কাজ। নভেরার কাজে উপাদানের একটা বড় ভূমিকা আছে। এক হিসেবে সে উপাদানের শিল্পী। তার ভাস্কর্যে আকার আর উপাদান খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

অনেকে বলেন, সে কোবরা গ্রুপের ভাস্কর। প্রকরণ ও কারিগরির কারণে ভাস্কর্য তো সাধারণত সব সময় চিত্রকলার পেছনে পড়ে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন শিল্পীর সংস্পর্শে এসে সে নিজেকে আলাদা করে গড়ে তুলতে পেরেছিল।

এবার নভেরার চিত্রকলার নিয়ে দু-একটা কথা বলা যাক। নভেরা সম্ভবত প্যারিসে স্প্রে পেইন্টিং শুরু করেছিল। ওর কাছে স্প্রে পেইন্টিং করার মানে ছিল এক রকম ভাস্কর্য তৈরি করা। নভেরা অন্য শিল্পীদের চেয়ে এই হিসেবে অর্ধশতক এগিয়ে ছিল। সে যেন ভবিষ্যতে বাস করত। তার সময়ের শিল্পীরা তাকে বুঝে উঠতে পারেননি।

নভেরা পরে যখন আবার তুলি হাতে নেয়, তখন যেন পরিস্থিতিই বদলে যায়। আমার মতে, তুলি দিয়ে আঁকা তার ছবিগুলোই সেরা, ঠিক যেমন তার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। এই কাজগুলো প্রাণবন্ত ও সৃজনশীল। নভেরা সব সময় বলত, শিল্পকর্ম হতে হবে জীবন্ত, মৃত হলে চলবে না। অন্যদের কাজ নিয়ে বলত, ‘এটা মরা, ওটা মরা।’ আবার কিছু কিছু কাজের প্রশংসা করত, বলত, ‘এটা বেঁচে আছে, জীবন্ত, সুন্দর।’

নভেরা ও গ্রেগোয়ার, ১৯৯০

নভেরার ছবিগুলো দারুণভাবে স্পন্দিত হতো, যেন রঙের এক সিম্ফনি। আমার এক সংগীতজ্ঞ বন্ধু ছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নভেরার কাজ নিয়ে তোমার কী মত? তিনি বলেছিলেন, ‘ওর কাজ রঙের সিম্ফনি। এর মধ্যে শিশুর মতো সতেজতা আছে।’

নভেরার শিল্পকর্মে একটা মরমি রহস্যও আছে। আমার এক রুশ বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নে বাস্তববাদী চিত্রকলা শিখেছিল। সে নভেরার কাজ খুব পছন্দ করত। তার একেবারেই বাস্তববাদী নিজস্ব একটি ধরন থাকা সত্ত্বেও নভেরার ছবি আর ভাস্কর্য তার ভালো লাগত। সবাই তার শিল্পীসত্তার ব্যাপারে একমত ছিল।

নভেরা আহমেদ রেট্রোস্পেক্টিভ প্রদর্শনীর ক্যাটালগের প্রচ্ছদ

আমি নভেরার জাদুঘরটি করেছি ভিন্ন একটি কারণে। আজকের সময়ে সাধারণ শিল্পজ্ঞান খুবই নিম্নমানের। সমসাময়িক শিল্পকলার বেশির ভাগই মূল্যহীন। ভালো কিছু কাজ অবশ্যই আছে, কিন্তু বেশির ভাগই ফাঁকা ও নির্জীব। সমসাময়িক শিল্প আসলে জল্পনামূলক। অধিকাংশ শিল্পী শুধু টাকার জন্য কাজ করেন। কাজগুলো বড়, কিন্তু ভেতরে কিছু নেই। তার ওপর এদের অনেকেই প্রকৃত অর্থে শিল্পী নন, শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য একটা কৌশল বের করে নিয়েছেন, আর সেটাই চালিয়ে যাচ্ছেন।

নভেরার কাজ সত্যিকারের শিল্পকর্ম। তার চিত্রকলা অসাধারণ। কিছুদিন আগে এক তরুণীকে নভেরার কাজ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী মনে হলো? সে বলল, ‘না, খুব বেশি রং। এত রং আমি পছন্দ করি না। ধূসর হলে বরং ভালো হতো।’

ম্যুজি নভেরা আহমেদ বা নভেরা আহমেদ জাদুঘর, লা–রশ গিয়ঁ, ফ্রান্স

পিকাসো আর মার্ক শাগাল একে অপরকে পছন্দ করতেন না। সেই পিকাসোও একবার শাগাল সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি অসাধারণ রঙের শিল্পী। তাহলে কেমন করে বলা যায় যে শিল্পে রং থাকা উচিত নয়? এখন তো অনেক ছবিই দেখি ধূসর বা বাদামি রঙে। একরঙা, প্রাণহীন। এরা মেঝের জন্য ঠিক আছে, কিন্তু দেয়ালে টাঙানোর জন্য নয়।

নভেরার কাছে শিল্প অবশ্যই জীবন্ত হতে হবে। শিল্প কেবল নির্জীব কোনো বস্তু নয়। তার কাজ যেন ঝনঝন করে, স্পন্দিত হয়, নতুন প্রাণের অনুভূতি এনে দেয়।

ছবির সূত্র: নভেরা: বিভুঁইয়ে স্বভূমে, আনা ইসলাম, জার্নিম্যান বুকস ও অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০২০