ইনসাফের লড়াই আরও দীর্ঘ

কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়ছবি: সাজিদ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি চত্বরে। ১৭ জুলাই ২০২৪

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এক সন্ধিক্ষণের মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যেকোনো সংকটকালে ‘বিদেশি’দের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ আয়োজন ও সমাধানের রাস্তা বের করার নজির এতকাল দেখে আসছি। এই প্রথম আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে, কীভাবে তার রূপান্তর ঘটবে—সে সিদ্ধান্ত কোনো ‘বিদেশি’ হস্তক্ষেপ ছাড়াই রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ সংলাপ ও তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে নিচ্ছে। নানা সীমাবদ্ধতাসহ এ অভূতপূর্ব ঘটনা গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ঘটছে।

গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ কেমন হওয়া উচিত, তার আইনকানুন, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হওয়া দরকার—তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে। তবে চব্বিশের জুলাই মাসে আমরা যে ধরনের সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছি, সেই আলোকে আমাদের আরও কিছু আলাপ করা দরকার ছিল বলে মনে করি, যা জনপ্রিয় পরিসরে এখনো অনুপস্থিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে এমন অনেক বিদ্বজ্জন জড়িত আছেন, যাঁরা প্রধানত ‘নাগরিক অধিকার’ নিয়ে কাজ করার জন্যই মশহুর। ফলে তাঁদের কাছে প্রত্যাশার পারদও ছিল উঁচুতে।

চব্বিশে আমরা যে ধরনের সহিংসতা দেখেছি, সেখানে কেবল কয়েকজন ব্যক্তির সম্পৃক্ততার বিষয় নয়; বরং সমাজের একটা বড় অংশ সেখানে জড়িত থাকে। আমলাতন্ত্র, পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বহু লোক এতে জড়িত থাকেন। সবাইকে যেমন আইনের সামনে নিয়ে আসা সম্ভব হয় নয়, তেমনি সবাইকে বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানোও সম্ভব হয় নয়। আবার প্রচলিত আইন এ ধরনের হত্যাযজ্ঞের বিচার করতে সক্ষম হয় না।

অন্যদিকে কেবল আইন-আদালতকেন্দ্রিক বিচার করলে এ সহিংসতার শিকার ভুক্তভোগীরা যে ধরনের ট্রমার ভেতর দিয়ে যান, সেটা নিরাময় করতে পারেন না। আবার এ ধরনের সহিংসতায় যে ধরনের বহুমাত্রিক ভুক্তভোগী তৈরি হন, প্রচলিত ব্যবস্থায় কেবল আপাতবিজয়ী গোষ্ঠীই নিজেদের ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে দাবি করতে পারে। ফলে কেবল তাদের সঙ্গে সংঘটিত সহিংসতার বিচারের দিকেই ধাবিত হন।

যখন কোনো সমাজে এ ধরনের বিরাট মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, তখন এর প্রভাব ও ধাক্কা সমাজ থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস করতে চাইলে আমাদের ইনসাফের একটা বিরাট ক্যানভাসের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রে সেই সহিংসতা যেন এমন কোনো ‘ক্ষত’ তৈরি করতে না পারে, যা ক্রমাগত সহিংসতার দুষ্টচক্র তৈরি করতে পারে।

মনে রাখা দরকার, সহিংসতার সঙ্গে আইডেন্টিটি বা পরিচয়ের সম্পর্ক নানামুখী হলেও প্রধানত দুই ধরনের সম্পর্ক দেখতে পাই আমরা। প্রথমত দেখি যে ‘পরিচয়’ই কখনো কখনো সহিংসতার কারণ হিসেবে উপস্থিত থাকে (আমরা যাকে নেতিবাচকভাবে আইডেন্টিটি পলিটিকস বলে নিন্দা করি)। দ্বিতীয়ত, সহিংসতা বা সহিংস অভিজ্ঞতা বা ইতিহাস খোদ সামষ্টিক ‘পরিচয়’ নির্মাণের অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল বের করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা
ছবি: সাজিদ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি চত্বরে। ১৭ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশ নামের এ ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিচয় ও ইতিহাস নির্মাণের সঙ্গে সহিংসতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধকালে জেনোসাইডমূলক সহিংসতার স্মৃতি আজতক ‘বাঙালি’র পরিচয় নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে টিকে আছে। একইভাবে বাংলাদেশের গত ৫০ বছরে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে যেমন জনগোষ্ঠীর রক্ত লেগে আছে, তেমনি সব গোষ্ঠীর রয়েছে ‘ভিকটিম’ হওয়ার অভিজ্ঞতা। সমতলের রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে যেমন এ ধরনের রক্তাক্ত ইতিহাস আছে, তেমনি পাহাড়ের সহিংসতাও সেখানে ‘পরিচয়’ নির্মাণে আরেক ধরনের ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।

আমরা যদি সামনের দিকে এগোতে চাই, তাহলে আমাদের দৃষ্টি আরও প্রশস্ত করা দরকার। বিশেষত একাত্তর সালে আমরা যে ধরনের বিপুল হত্যাযজ্ঞের ঘটনা দেখেছি বা আওয়ামী শাসনামলে গুম, ক্রসফায়ারসহ যে অজস্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দেখেছি বা চব্বিশে যে ধরনের সহিংসতা দেখেছি, তাতে কেবল জুডিশিয়াল জাস্টিস বা প্রচলিত আইন-আদালত দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এখানেই আমরা ক্রান্তিকালীন ইনসাফ বা ট্রানজিশনাল জাস্টিসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চাই।

ক্রান্তিকালীন ইনসাফ ধারণা হিসেবে নতুন। এর মূল ধারণা হচ্ছে অতীতের সহিংসতার মুখোমুখি হওয়া, মোকাবিলা করা এবং এর থেকে নিরাময় লাভ করা। এর সঙ্গে কয়েকটা মৌলিক বিষয় জড়িত থাকে। প্রথমত, যারা জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনা। দ্বিতীয়ত, প্রতিশোধমূলক মনোবৃত্তি পেছনে রেখে অতীতের মুখোমুখি হওয়া। তৃতীয়ত, এ ধরনের সহিংসতার ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাগরিকের যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সেটা লাঘব করা। চতুর্থত, সহিংসতার ফলে বিভাজিত সম্প্রদায়ের ভেতর সম্প্রীতি ও আস্থা ফিরিয়ে আনা। পঞ্চমত, ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং ষষ্ঠত, একটি অংশীদারমূলক ইতিহাস ও স্মৃতির বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হওয়া। এ কর্মযজ্ঞের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইনসাফ প্রদান করা এবং সমাজে এ ধরনের সহিংসতার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করা।

ক্রান্তিকালীন ইনসাফের প্রথমেই আসে অপরাধমূলক বিচারের প্রসঙ্গ। সহিংসতা বা হত্যাযজ্ঞ বা ধ্বংসযজ্ঞের নির্দেশদাতা, পরিকল্পনাকারী এবং মূল বাস্তবায়নকারীদের আইনের মুখোমুখি করতে হবে। কখনো কখনো এ ধরনের সহিংসতার বিচার প্রচলিত আইনি কাঠামোতে সম্ভব হয় না, তখন বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল করতে হয়। বাংলাদেশে এটা করা হলেও এর আন্তর্জাতিক মান নিয়ে অজস্র প্রশ্ন
রয়ে গেছে।

এরপরই আসে সর্বাধিক অনালোচিত বিষয়—ট্রুথ কমিশন গঠন। আমরা জানি, জুডিশিয়াল বিচার বিস্তৃত সহিংসতার বিচিত্র দিককে আমলে নিতে পারে না। ফলে এখানে এমন এক ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজন হয়, যেখানে ভুক্তভোগীরা তাঁদের স্মৃতি ও গল্প তাঁদের জবানিতেই বলতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন হয় ট্রুথ কমিশনের। এমন নয় যে এই ট্রুথ বা সত্য কেউ জানতেন না। জানা ও স্বীকৃতির মধ্যে ফারাক রয়েছে। ভুক্তভোগী যখন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার বদলে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেন, তখন পুরো প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। গুম বা ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা কীভাবে ঘটে এবং তার মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে কী নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমেই ফুটে ওঠে। ফলে এ ধরনের কমিশন আসলে আর্কাইভ গড়ে তুলতে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি অংশীদারমূলক ইতিহাস তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা শেষে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কফিন মিছিল বের করলে পুলিশ মিছিলটি লক্ষ্য করে একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার সেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে
ছবি: সাজিদ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি। ১৭ জুলাই ২০২৪

তৃতীয়ত আসে ক্ষতিপূরণ। যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি চিকিৎসা দিতে হয়। এ ধরনের ক্ষতিপূরণ কেবল ভুক্তভোগীকে তাঁদের নিজেদের জীবন নতুন করে গড়ে তুলতেই সহায়তা করে না; বরং এর একধরনের প্রতীকী মূল্যও রয়েছে। তবে এ ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদান সমাজে যেন আবার বিভাজন তৈরির রাস্তা না হয়, সেদিকেও মনোযোগ দেওয়া দরকার। ক্ষতিপূরণ বিষয়ে আলোচনাতে আমাদের মনে রাখা দরকার, এটা যেন নির্বাচিত না হয়ে ওঠে। অভ্যুত্থানে ও অভ্যুত্থান–পরবর্তী সহিংসতায়ও যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদেরও নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের এ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কেননা সহিংসতা–পরবর্তী স্থিতিশীল সমাজের জন্য এটা প্রয়োজনীয়। অন্যথায় এক সমাজের গোষ্ঠীর মানসিক ক্ষত নিরাময় হলেও অন্য গোষ্ঠীর সেই ক্ষত বৃদ্ধি পেয়ে উল্টো সমাজে সহিংসতার চক্র চলতে থাকবে।

চতুর্থত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। চব্বিশের জুলাই মাসে আমরা যে ধরনের সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছি, তার ফলে নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এক গভীর অনাস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। কেননা সহিংসতার সঙ্গে নানা মাত্রায় এসব প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যেমন রদবদলের জরুরত দেখা দেয়, তেমনি কাঠামোগত দিক থেকেও এসবের সংস্কার করতে হয়।

পঞ্চমত হচ্ছে স্মৃতিচারণা ও স্মৃতি সংরক্ষণ। তবে মনে রাখা দরকার, এ ধরনের স্মৃতিচারণার পরিসর যেন আমাদের জন্য সামষ্টিক নিরাময়ের পরিসরে পরিণত হয়, নইলে এগুলোও সমাজে ট্রমা বাড়াতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণামূলক পরিসরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি, সেগুলোর অভিমুখ ইনসাফের দিকে না গিয়ে জাতীয়তাবাদী প্রচারণার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তা ভুক্তভোগীর মানসিক ক্ষতকে নিরাময় না করে উল্টো সমাজে ট্রমা উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, সহিংসতাকে ঐতিহাসিকভাবে মোকাবিলা না করা গেলে এক সহিংসতা পরিচয় নির্মাণের উপাদান হিসেবে কাজ করে, কিছুদিন পর নতুন সহিংসতার জমিন তৈরি করে। বিচার দাবির আন্দোলনও অবিচার আদায়ের উপলক্ষে পরিণত হয়েছিল। এখানে ক্রমাগত জালিম ও মজলুমের সম্পর্কের অদলবদল ঘটছে। আজকে যে মজলুম, সে কাল মজলুমিয়াতকে এস্তেমাল করে আবার জালিমে পরিণত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ যেন এক সহিংসতার দুষ্টচক্রের আবর্তে পড়ছে। এ দুষ্টচক্র ভাঙার জন্য আমাদের ইনসাফের এ বৃহৎ পরিসর নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা কেবল প্রতিশোধমূলক বিচার চাই না; বরং ইনসাফ কায়েম করতে চাই। আমরা এমন কোনো বিচার চাই না, যেখানে জালিম আবার মজলুমে পরিণত হয়।


সহুল আহমদ: গবেষক