বদলে গেল জীবনধারা

পুরান ঢাকার চকবাজারের ব্যস্ত সড়কটি প্রতিবারের মতোই সেজে উঠেছে ইফতারি কেনাবেচার চিরাচরিত রূপে। ক্রেতা-বিক্রেতায় সরগরম পুরো এলাকা। গতকাল বিকেলে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

পথে নেমেই মনে হলো, দিনটা প্রতিদিনের মতো নয়। শুক্রবার ছুটির দিনে তো একটু ভিন্নতা থাকেই। কিন্তু এ পরিবর্তন তার চেয়েও বেশি। দুপুর প্রায় ১২টা, তবু সড়কগুলো প্রায় নিরিবিলি। যানবাহন চলছে গুটি কয়েক। পথের দুই পাশের দোকানপাটের ঝাঁপ নামানো। ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও থেকে গুলিস্তান হয়ে সিদ্দিকবাজার, বংশাল দিয়ে বাদামতলী পেরিয়ে মিটফোর্ড অবধি যেতে যেতে প্রায় একই রকম দৃশ্য। মন্থরতা জড়িয়ে আছে রাজধানীর জনজীবনে।

দোকানপাট তো বন্ধই, এমনকি হোটেল–রেস্তোরাঁ, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানও প্রায় খদ্দেরশূন্য। প্রকাশ্যে বিড়ি–সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে দেখা যাচ্ছে না। বরং চোখ জুড়িয়ে দেয় উজ্জ্বল রোদে গাছে গাছে ঝলমল করতে থাকা সদ্য গজানো কচি পাতা। প্রকৃতিতে এখন বসন্ত। দালানকোঠায় ঠাসা মহানগরীর চেহারাই বদলে গেছে এই নিষ্কলুষ সবুজের বিপুল সমারোহে। রুক্ষতায় পড়েছে লাবণ্যের প্রলেপ। আরও এক বসন্ত এসেছে মুসলিম জনসাধারণের জীবনে। তা হলো ‘ইবাদতের বসন্ত’খ্যাত পবিত্র রমজান মাস।

শীতের পর বসন্ত এসে যেমন তার দীপ্ত কিরণে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়েছে প্রকৃতিতে, জাগিয়েছে বিপুল প্রাণের স্পন্দন, তেমনি সারা বছরের গতানুগতিক ভালোমন্দে মেশানো জীবনযাত্রায় পবিত্র রমজান মাস এনেছে এক বিপুল পরিবর্তন। তাতেই বদলে গেছে জীবনধারা, নাগরিক দৃশ্যপট। দিবাভাগে পানাহারবঞ্চিত থাকার শারীরিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি লোভ, লালসা, হিংসা, ক্রোধ, মিথ্যা রিপুর তাড়নার মতো মানবিক প্রবৃত্তিগুলোকে দমন করে আত্মিক পরিশুদ্ধি, ক্লেদমুক্ত হয়ে পরিচ্ছন্নতার সাধনা শুরু করেছেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। সবাই সচেষ্ট হয়েছেন যত বেশি সম্ভব ইবাদত–বন্দেগিতে নিমগ্ন হতে। ওয়াক্তের নামাজের অতিরিক্ত তারাবিহ, তাহাজ্জত, নফল নামাজ আদায় করছেন। এটি কোরআন নাজিলের মাস। সে কারণে এই মাসে রোজাদারেরা মনোযোগী হন কোরআন তিলাওয়াতে। দান–সদকার হাত প্রসারিত করেন। সবটা মিলিয়েই প্রকৃতি যেমন এখন ধুলাবালুমুক্ত পরিচ্ছন্ন সজীব, তেমনি ইবাদত–বন্দেগির মধ্য দিয়ে মানুষও চেষ্টা করছেন এক পরিচ্ছন্ন, নিষ্কলুষ জীবনে প্রবেশের অভিলাষে। এবার প্রকৃতির বসন্ত আর ইবাদতের বসন্ত একত্রে এসেছে ধর্মপ্রাণ বাঙালির জীবনে।

এবার ইফতারির দাম তুলনামূলক বেশি। গতকাল চকবাজারে
ছবি: প্রথম আলো

এবার রমজান শুরু হলো জুমাবার থেকে। মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের উপস্থিতিও ছিল অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই গতকাল রমজান মাসের ফজিলত নিয়ে আলোচনা হলো মসজিদে মসজিদে জুমার খুতবায়। বয়ান করা হলো পরম করুণাময় আল্লাহ এই মাসে বান্দার প্রতিটি ইবাদতের সওয়াবই বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন। প্রথম ১০ দিনে মহান আল্লাহ তাঁর অনুগত বান্দাদের জন্য রহমতের দরজা উন্মুক্ত করবেন। এর পরের ১০ দিনে রয়েছে মাগফিরাত। মহান আল্লাহ মাফ করবেন অনুগ্রহপ্রাপ্তদের গুনাহ। আর শেষ ১০ দিনে নাজাত, অর্থাৎ দোজখের আগুন থেকে মুক্ত করবেন বান্দাদের। উপরন্তু শেষ ১০ দিনের কোনো এক রাতে রয়েছে অতীব মর্যাদাপূর্ণ পবিত্র শবে কদর। এই একটি রাতের ইবাদত হাজার রাতের ইবাদতের চেয়েও বেশি। কাজেই পুণ্যলাভের এ বিপুল সুযোগ গ্রহণ করতে কসুর করছেন না কেউ। করা উচিতও নয়।

আরও পড়ুন

রোজায় আত্মসংযমের শিক্ষা থাকলেও বাজার অবশ্য অসংযমী হয়ে উঠেছে। সকালের মন্থরতা কেটে গিয়ে দুপুরের পর থেকেই ব্যস্ততা বাড়তে থাকে ঘরে-বাইরে। গৃহিণীরা আয়োজন শুরু করেন ইফতারসামগ্রী তৈরির। আর বাইরে হোটেল–রেস্তোরাঁগুলোর সামনে টেবিল পেতে লাল সালু বিছিয়ে পসরা সাজানো হয় ইফতারির ঐতিহ্যবাহী হরেক রকম পদের। খুব খ্যাতি পাওয়া পুরান ঢাকার চকবাজারে জুমার নামাজের পরপরই সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে বসে যায় ইফতারির বাজার। তবে ক্রেতাদের আসার আগেই এল বৃষ্টি। অবশ্য ভারী নয়, ছিটেফোঁটা। ফলে কাবাব, ঘুগনি, ছোলা, সমুচা, পেঁয়াজি ভালো করে মুখ দেখানোর আগেই তাদের ঢেকে ফেলতে হলো পলিথিনের পর্দায়।

আরও পড়ুন

এবার মুরগি থেকে গরু, খাসি, তেল, চিনি—সবকিছুরই দাম বেড়েছে। তাই ইফতারিও অগ্নিমূল্য। কাবাব বিক্রেতা শাহাদত মিয়া জানালেন, শামি কাবাব, জালি কাবাব এগুলো প্রতিটি গতবার ছিল ২০ টাকা, এবার ৩০ টাকা। মুরগির রোস্ট বা ফ্রাই প্রতিটি ৮০ টাকা, গত বছর ছিল ৫০ টাকা, ৩০ টাকার চিকেন শাশলিক ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ডিমের দাম চড়া, তাই গতবারের ১০ টাকার ডিমচপ এবার ১৫ টাকা।

গুলিস্তানের ইফতারি বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন জানালেন, ছোলার কেজি ১২০ টাকা থেকে হয়েছে ১৬০ টাকা। পেঁয়াজি, বেগুনি, সবজির পাকোড়া গতবার প্রতিটি ছিল ছয় টাকা, এবার ১০ টাকার নিচে নেই। তবে এবার আকার একটু বড় হয়েছে। জিলাপি ১৮০ টাকা ছিল, এবার ২০০ থেকে ২২০ টাকা। গরুর হালিমের যে বাটি ছিল ৫০০ টাকা, এবার তার দাম ৭০০।

কাঁচা বাজারে সামনের সারিতে চলে এসেছে লেবু, শসা, টমেটো, গাজর, বেগুন, কাঁচামরিচ প্রভৃতি। দাম সেখানেও ঊর্ধ্বমুখী। আচমকা ৫০ টাকার বেগুন উঠেছে ৮০ টাকায়। পয়লা রমজানের মধ্যবেলায় যে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি নামল রাজধানীতে, লোকমুখে তার পরিচিতি ‘ছাগল তাড়ানো বৃষ্টি’ বলে। তাতে আবহাওয়া কিছুটা মোলায়েম হয়ে এলেও কোনো প্রভাব পড়ল না বাজারের উত্তাপে।

একটু একটু করে সময় গড়িয়ে হলো বিকেল। ভিড় বাড়ল পাড়া–মহল্লার ইফতারির দোকানে। রোজাদারেরা চেষ্টা করেছেন প্রথম দিন পরিবারের সঙ্গে একত্রে ইফতার করতে। ছুটির দিন বলে অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয়েছে। খাদ্য-পানীয় নিয়ে তাদের অপেক্ষা ছিল সূর্যাস্তের। পুণ্যের আশায়, সংযমের সাধনায় রমজান মাসের দিনগুলো কাটবে এভাবেই।