লক্কড়ঝক্কড় বাস-ট্রাক ৮০ হাজারের বেশি, ঢাকা ও আশপাশে আজ থেকে অভিযান
২০ বছরের পুরোনো বাস ও ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক জব্দ করা হবে।
সরকার এসব যান ওঠাতে মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল।
পরিবহন মালিক–শ্রমিকেরা মানতে চাইছেন না। ধর্মঘটের হুমকি।
দেশে পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় যানবাহনের সংখ্যা ৮০ হাজার ৩০৯। ছয় মাস সময় দেওয়ার পরও যানবাহনের মালিকেরা এসব লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন সড়ক থেকে তুলে নেয়নি। এ জন্য এবার সরকার পুরোনো যানবাহন উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে। আজ রোববার থেকে ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হচ্ছে। এই অভিযান প্রথমবারের মতো দিনের পাশাপাশি রাতেও চলবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, গত জুন পর্যন্ত সারা দেশে ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকারের সংখ্যা ৪১ হাজার ১৪০। সারা দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৩৯ হাজার ১৬৯। তবে পুরোনো যানবাহনের মালিক-শ্রমিকেরা অতীতের মতো এবারও ধর্মঘটের মাধ্যমে এই উদ্যোগ আটকে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০২৩ সালের ১৭ মে বাস-মিনিবাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করেছিল ২০ বছর। আর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ মালবাহী যানের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫ বছর। তবে তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে পিছু হটে। পুরোনো যানবাহন সড়ক থেকে উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৬ জুন পুরোনো যানবাহনের বয়সসীমার আগের প্রজ্ঞাপনটি বহাল করে। পাশাপাশি এসব যান সড়ক থেকে উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, পুরোনো যানবাহন সড়ক থেকে উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়ে গত ২৪ জুন বিআরটিএতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংস্থাটির কর্মকর্তা ছাড়াও পরিবহন মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে পুরোনো যানবাহন জব্দ করে সেগুলো ডাম্পিং স্টেশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
সড়ক থেকে তুলতে আজ থেকে অভিযান শুরু হচ্ছে। বিআরটিএ ৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাবে।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, এই অভিযানে লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন ছাড়াও চলাচলের অনুমতিবিহীন (রুট পারমিটহীন), পরিবেশ দূষণকারী, রংচটা এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহনও জব্দ করা হবে। এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা সারা দেশে পাঁচ লাখের বেশি। এসব যানের বয়স কম হলেও সেগুলো পাল্লাপাল্লি করে চালানোর কারণে রংচটা হয়ে গেছে। এ ছাড়া পরিবহন মালিকদের অবহেলায় সরকারি ফি দিয়ে ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করা হয়নি। কেউ কেউ নির্ধারিত রুটে না চালিয়ে অন্যত্র বাস চালাচ্ছেন।
৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ৪টি ডাম্পিং স্টেশন
বিআরটিএ ৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলোতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি বিআরটিএ কর্মকর্তা, মোটরযান পরিদর্শক এবং পরিবহন মালিক সমিতির নেতারাও থাকবেন। বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো সার্কেল-২–এর আওতায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, বাবুবাজার সেতু, কেরানীগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। শহরের ভেতরে নিউমার্কেট, কলাবাগান, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বছিলা, আঁটিবাজারসহ আশপাশের এলাকায় একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আরেকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে।
মতিঝিল, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, সাইনবোর্ড, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে আরেকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। ৩০০ ফুট সড়ক, পূর্বাচল, রূপগঞ্জের কাঞ্চন সেতু ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অংশবিশেষে আরেকটি আদালত পরিচালনা করা হবে।
ঢাকার ভেতরে শাহবাগ, ফার্মগেট, মহাখালী, কাকলী, বিমানবন্দর, উত্তরা ও এর আশপাশে আরেকটি আদালত পুরোনো যানবাহন জব্দ করার জন্য অভিযান পরিচালনা করবে। ঢাকার উত্তরাংশের প্রবেশমুখগুলোতে পুরোনো যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী, ঢাকা-টাঙ্গাইল এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এলাকায়। পশ্চিমাঞ্চলে কল্যাণপুর, গাবতলী বাস টার্মিনাল, মিরপুর, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক এলাকাতেও থাকবে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। ঢাকার ভেতরে গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী ও যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় থাকবে আরেকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। মৌচাক, মালিবাগ, মৎস্য ভবন, কাকরাইল এলাকায় অন্য আরেকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ভ্রাম্যমাণ আদালতে যানবাহন জব্দ করা হলে সেগুলো ঢাকা ও এর আশপাশে তিনটি স্থানে রাখা হবে। এ জন্য ঢাকা মহানগর দক্ষিণ অংশের জব্দ যানবাহন রাখা হবে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশে প্রিয় প্রাঙ্গণ হাউজিং ও ঝিলমিল প্রকল্প এলাকায়। উত্তর অংশের জব্দ যানবাহন রাখা হবে দিয়াবাড়ি গরুর হাট এবং পূর্বাচল ১৩ নম্বর সেক্টরে।
পরিবহন মালিকেরা আগ্রহ দেখাননি
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকারের আমলে ‘যানজট ও বায়ুদূষণ’ নিরসনে পুরোনো যানবাহন উঠিয়ে দেওয়াসহ পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে দুই দফা বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠক হয় গত বছরের ২৪ অক্টোবর। পরেরটি হয় ১৯ ডিসেম্বর।
২৪ অক্টোবরের বৈঠকে পুরোনো যানবাহনের বিষয়ে দুটি বড় সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমটি হলো, ছয় মাস পর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া যানবাহনের নিবন্ধন বাতিল করে সড়ক থেকে প্রত্যাহার এবং সেগুলো ডাম্পিং স্টেশনে পাঠিয়ে ধ্বংস করে দিতে হবে। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হলো, অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া যানবাহনের মালিকেরা যাতে নতুন যানবাহন কিনতে পারেন, সে জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উদ্যোগটি সড়ক পরিবহন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। এতে স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
সরকারের সিদ্ধান্তের পর ২০ বছরের পুরোনো বাস ও ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ঢাকা মহানগর থেকে অপসারণের বিষয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে বিআরটিএ। গত ১৬ জানুয়ারি যানবাহন মালিক সমিতিগুলোকে বিআরটিএর পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, পুরোনো যানবাহনের স্থলে নতুন যানবাহন নামাতে ব্যাংকঋণ পেতে সহায়তার প্রয়োজন হলে সরকারের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ করা হয়। এর বাইরে বিআরটিএর আর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।
গত মে মাসে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হয়েছে। তবে পরিবহন মালিকেরা নিজ উদ্যোগে লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন উঠিয়ে নেননি। এ অবস্থায় বিআরটিএ ১ জুলাই থেকে অভিযানে নামার ঘোষণা দেয়। কিন্তু পরিবহন মালিকদের চাপে তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। এখনো পুরোনো যানবাহন বন্ধের উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। তাঁরা সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘটের মাধ্যমে অচল করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো যানবাহন তুলে নিয়ে সেগুলো কীভাবে স্ক্র্যাপ করা হবে, এর স্থলে মালিকেরা আরেকটি বাস বা ট্রাক নামাতে পারবে কি না, এ বিষয়ে সরকারের কোনো নীতিমালা নেই। এ ছাড়া পুরোনো বাস-ট্রাকের পরিবর্তে নতুন যান নামাতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কথা বলেছে সরকার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পরিপত্র জারি করেনি। ফলে সারা দেশে পুরোনো যানবাহনের মালিক-শ্রমিকেরা সংক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মঘটে যাওয়ার চিন্তা করছে।
সাইফুল আলম বলেন, আজ রোববার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সব সংগঠন নিয়ে বৈঠক করবেন তাঁরা। সেখান থেকে তাঁরা তাঁদের দাবিদাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরবেন। দাবি মানা না হলে কর্মসূচিতে যেতে হবে তাঁদের।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এহসানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো যানবাহনের মালিক-শ্রমিকেরা বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে এসব যান উঠিয়ে নেননি। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে অভিযানে যাচ্ছে। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি থাকলে সরকার শুনবে, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করবে।