ক্ষত সারাতে হাজার কোটির প্রকল্প

প্রকল্পের আওতায় ৯টি জেলায় সড়ক–সেতু–কালভার্ট নির্মাণ ও সংস্কারকাজ করা হবে।

গত বছরের বন্যায় নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব সড়কে চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে লোকজনকে। শনিবার কলমাকান্দার ডুবিয়ারকোনায়
ছবি: পল্লব চক্রবর্তী

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া-তেলিকোনা সড়কটি গত বছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক বছরের বেশি সময় পেরোলেও সড়কটি সংস্কার করা হয়নি। সড়কের অধিকাংশ জায়গায় পিচ উঠে ঢালাই বের হয়ে আছে। সড়কজুড়ে ছোট-বড় গর্তে বৃষ্টির পানি জমে বিঘ্নিত হচ্ছে যানবাহন চলাচল।

সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় এ সড়কের মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বহু সড়ক ও সেতু। সেগুলো এখনো সংস্কার করা হয়নি। এ কারণে ভোগান্তিতে আছেন সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর বাসিন্দারা। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, সেতু ও কালভার্ট পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারে হাজার কোটি টাকার আলাদা একটি প্রকল্প নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।

প্রকল্পের নাম ‘এডিবির জরুরি সহায়তায় বন্যা ২০২২-এ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অবকাঠামো পুনর্বাসন’। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের বড় অংশই বৈদেশিক ঋণ। প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৯০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিচ্ছে। বাকি টাকা সরকারি অর্থ।

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, কলমাকান্দার চিনাহালা মোড় থেকে বরুয়াকোনা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত সড়কটি মেরামত হয়নি। ডুবিয়ারকোনা মোড় থেকে এতিমখানা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়কও ভাঙাচোরা।

প্রকল্পে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর ও কুড়িগ্রাম—এ নয়টি জেলা অন্তর্ভুক্ত। প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ তিন বছরের বেশি সময় ধরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও সেতু মেরামতের কাজ চলবে।

সুনামগঞ্জে গত বছর বন্যা হয় তিন দফায়। এর মধ্যে জুনে ভয়াবহ বন্যায় গ্রামীণ সড়ক তছনছ হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বহু সেতু, কালভার্ট। সড়ক-সেতুর অনেকগুলোই এখনো সংস্কার করা হয়নি। এতে ভোগান্তি শেষ হচ্ছে না স্থানীয় বাসিন্দাদের।

বন্যায় জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ছোট-বড় ৮৪টি সড়ক (১৮০ কিলোমিটার) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রসুলগঞ্জ বাজার থেকে লামা রসুলগঞ্জ লাউতলা সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সড়কজুড়ে খানাখন্দ। লাউতলা গ্রামের বাসিন্দা বুরহান উদ্দিন বলেন, লাউতলা এলাকায় সড়ক ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেখানে বাঁশ ফেলে পথচারীরা পার হচ্ছেন।

কলকলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুল হাশিম বলেন, ওই বন্যায় কলকলিয়া-তেলিকোনা সড়কসহ বেশ কয়েকটি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়কে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। বেহাল সড়কগুলোয় চলতে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বড় গর্তগুলো ভরাটে এলাকাবাসীর উদ্যোগে একাধিকবার খোয়া ফেলা হয়েছে।

দেশের সবচেয়ে বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্ক এলজিইডির। সংস্থাটির আওতায় ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯২১ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর অর্ধেকের বেশিই কাঁচা সড়ক।

এলজিইডি সুনামগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় সংস্থাটির অধীনে সড়ক আছে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি। বন্যায় ১২টি উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়। সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১২০টি। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের কতটুকু সংস্কার করা হয়েছে, সে হিসাব সংস্থাটি দিতে পারেনি।

নেত্রকোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলার সড়ক। আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে সোমেশ্বরী নদীর পানি উপচে সড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কলমাকান্দা এলজিইডি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১৪০ কিলোমিটার কাঁচা ও পাকা সড়ক। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে বেশি ক্ষতি হয়েছে রংছাতি, লেংগুরা, খারনৈ, পোগলা ও বড়খাপনে।

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, কলমাকান্দার চিনাহালা মোড় থেকে বরুয়াকোনা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত সড়কটি মেরামত হয়নি। ডুবিয়ারকোনা মোড় থেকে এতিমখানা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়কও ভাঙাচোরা। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক রমিজ মিয়া বলেন, ‘বন্যার পানিতে ভাঙলেও এখনো ঠিক করে নাই। অটো চালাতে গেলে গর্তে পড়ে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে।’

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কোন সড়ক কখন সংস্কার করা হবে, সেটার অগ্রাধিকার তালিকা করা হয়েছে। জেলাগুলো থেকে দরপত্র–সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আসছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। দ্রুতই কাজ শুরু হবে
প্রকল্প পরিচালক, মো. রেজাউল হক

জাতীয় সড়কব্যবস্থার শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সড়কের একক দায়িত্ব এলজিইডির। নিজেদের আওতাধীন গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন-রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্ক এলজিইডির। সংস্থাটির আওতায় ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯২১ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর অর্ধেকের বেশিই কাঁচা সড়ক।

এলজিইডির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছর সংস্থার বাজেটে সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ নির্দিষ্ট টাকা বরাদ্দ থাকে। অনেক সময় বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে একাধিক জেলার সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দ থেকে সংস্কার করা সম্ভব হয় না। এ পরিস্থিতিতে আলাদা প্রকল্প নেওয়া হয়। একইভাবে গত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পটির আওতায় ৪০৬ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক, ৩৪৬ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক, ২ হাজার ১৭১ মিটার সেতু ও ৮০৯ মিটার কালভার্ট পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হবে। সড়ক রক্ষায় দেয়াল (টো ওয়াল) নির্মাণ করা হবে ৬২ কিলোমিটার। রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে ২ লাখ ২১ হাজার বর্গমিটার সড়কের ঢাল।

সম্প্রতি এই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মো. রেজাউল হক। তিনি বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কোন সড়ক কখন সংস্কার করা হবে, সেটার অগ্রাধিকার তালিকা করা হয়েছে। জেলাগুলো থেকে দরপত্র–সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আসছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। দ্রুতই কাজ শুরু হবে।’ 

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা অমিত কান্তি দেব, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ]