ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করা হবে: উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ (সত্য এবং পুনর্মিলন) কমিশন গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ঘৃণ্য অপরাধীরা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। তারা (অপরাধীরা) যে এ জাতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হলেও ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করতে হবে।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর দ্বিতীয় খসড়ার ওপর মতবিনিময় সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
ট্রুথ জাস্টিস কমিশন অথবা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের খুব দরকার উল্লেখ করে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, এটা সম্ভবত ১৯৭২ সাল থেকে থাকলেই ভালো হতো। অনন্তকাল হানাহানি করে এ জাতির মুক্তি হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
আসিফ নজরুল বলেন, ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনের বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে ও বিস্তারিত জানতে একটি প্রতিনিধিদল দক্ষিণ আফ্রিকা যাবে। এই প্রতিনিধিদলে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ থাকবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনিও যাবেন।
বর্ণবাদের বিভাজন দূর করে সংহতি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৫ সালে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সত্য উদ্ঘাটন, বিচার ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে দেশটিতে ওই কমিশন গঠন করা হয়েছিল।
‘গুম রাজনৈতিক ইস্যু’
মতবিনিময় সভায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকারসংক্রান্ত আইন তাঁরা করে যেতে চান। কারণ, পরবর্তী সময়ে যাঁরা সরকারে আসবেন, তাঁরা এ ধরনের আইন করবেন কি না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই আইন খুব শক্তিশালী করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।
সভায় কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে হলে ন্যায়বিচারে যেতে হবে। অপরাধী (গুমের সঙ্গে যারা জড়িত) কিন্তু রাষ্ট্র। ফলে এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে? এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন গঠন করতে হবে।
ফরহাদ মজহার বলেন, তাঁর ভয় হয়, এখন যাঁরা উপদেষ্টা, যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদেরকে গণ–আদালতে উঠতে হতে পারে। এটা খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি। ফলে এখন যা কিছু করা হচ্ছে তা সততার সঙ্গে, স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে, একসঙ্গে থাকতে হবে।
গুম রাজনৈতিক ইস্যু; আইনি ইস্যু নয় বলেও উল্লেখ করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, এই ইস্যু সমাধান করতে না পারলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটা ভয়াবহ অস্থিতিশীলতার দিকে চলে যাবে।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘যারা এই গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল, আপনি যদি তাদের এখন বিচার করতে যান, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকবে না। এটা হচ্ছে রিয়েলিটি (বাস্তবতা)। লুকিয়ে লাভ নাই। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্টস। যদি তা হয়ে থাকে, আমাদের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে হবে, তারা কী করে এটাকে সমাধান করেছে। তারা সমাধান করেছে ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশনের মাধ্যমে আলাদা একটা কমিশন করে।’
ফরহাদ মজহার বলেন, যখনই গুমসংক্রান্ত আইন করার বিষয়টি এগোবে, সঙ্গে সঙ্গে যারা শক্তিশালী তারা...। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় এখনো রয়েছে তারা।
পক্ষে–বিপক্ষে মত
সরকারের তিনজন উপদেষ্টাসহ আইনজীবী, অধিকারকর্মী, অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা গুমসংক্রান্ত আইনের খসড়ার ওপর মতামত দিয়েছেন।
সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার চায় গুমের ঘটনা কমে যাক। এমন মাত্রায় কমে যাক যে আর কমিশনেরই প্রয়োজন না হয়। সেটাই যদি হয়, তাহলে এই আইনের সে অর্থে প্রয়োজন থাকে না।
আইনের খসড়ায় জেলায় জেলায় গুমসংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা বলা হয়েছে, এটিরও প্রয়োজন দেখছেন না সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, গুম কমিশনের তদন্তে শৃঙ্খলা বাহিনীর দায় পাওয়া যাচ্ছে। এই আইন করা হলে তাতে ‘ব্যক্তি বা কর্মকর্তা’র পরিবর্তে ‘শৃঙ্খলা বাহিনী’ রাখার প্রস্তাব করেন তিনি।
গুম প্রতিরোধে একটি আইন থাকা দরকার বলে মনে করেন শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার। তবে আইনে ফাঁসির বিধান না রাখার পক্ষে তিনি।
শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার বলেন, আইনে যখন ফাঁসির বিধান থাকে, তখন বিচারকেরা অনেকখানি পিছিয়ে যান। বিচারপ্রক্রিয়ায় সময় নেওয়ার ব্যাপার থাকে। যদি দ্রুততার সঙ্গে সুষ্ঠু বিচারকার্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন শাস্তির বিধান থাকাই যথেষ্ট। বেশি করতে গেলে অনেক সময় বিচার না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আইনে সর্বনিম্ন অর্থদণ্ড কত হওয়া উচিত, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’
গুমসংক্রান্ত আইন আসলে প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্ন রাখেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে একটাও গুমের ঘটনা ঘটেনি। আশা করা যায়, কোনো গুম হবে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, এই আইনের যে খসড়া করা হয়েছে, তাতে মামলা হওয়ার আগের প্রক্রিয়াটি ‘জটিল’ করে তোলা হয়েছে। এর ফলে আসামিপক্ষ বাড়তি সুবিধা পাবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম মনে করেন, গুমসংক্রান্ত আইনের প্রয়োজন আছে। আইনে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ (শীর্ষ নেতৃত্বের দায়) সঠিকভাবে ডিফাইন (সংজ্ঞায়িত) করতে হবে। তাদেরকে দায়বদ্ধ করতে হবে। যারা কমান্ডার (নির্দেশদাতা), তাদের যদি সঠিকভাবে দায়বদ্ধ করা না যায়, জবাবদিহির আওতায় আনা না যায়, তাহলে এ ধরনের (গুম) অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায় না।
মতবিনিময় সভায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সমাজকর্মী ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর নাম পরিবর্তনের সুপারিশ করেন। এই আইনের শিরোনাম পরিবর্তন করে ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার এবং সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ করা যেতে পারে, যাতে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির পরিবার এই আইনের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সুরক্ষা পান। পরিবারের সুরক্ষার প্রয়োজনীয় বিধিবিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করারও প্রস্তাব দেন তিনি।
খসড়া আইনে কমান্ডারদের (নির্দেশদাতারা) রেসপনসিবিলিটি (দায়) যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি বলেও উল্লেখ করেন পিনাকী ভট্টাচার্য।
এই আইনের প্রয়োজন আছে, তবে আইনটির খসড়ায় এর মূল উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়নি বলে উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস।
মতবিনিময় সভায় সঞ্চালক ছিলেন গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম। আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী সায়রা রহমান খান ও রেজাউর রহমান লেনিন।