মালকা বানু ও মনু মিয়ার প্রেম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পাইক-পেয়াদা নিয়ে জমিদার মনু মিয়া গিয়েছিলেন তাঁর জমিদারি তদারক করতে। গ্রামের পথে যেতে যেতে মক্তবে এক বালিকাকে দেখে মুগ্ধ মনু মিয়া যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন। প্রথম দেখাতেই নয়-দশ বছর বয়সের ওই বালিকার প্রেমে পড়লেন মনু মিয়া। খোঁজ নিয়ে জানলেন, ওই বালিকার নাম মালকা বানু। গ্রামেরই অবস্থাপন্ন সওদাগর আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর মেয়ে সে। জমিজমার খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে আসা মনু মিয়া কর্তব্যকর্ম ভুলে দিওয়ানা হয়ে পড়লেন।

দেরি না করে হাজির হলেন সওদাগর আমির মোহাম্মদের বাড়িতে। নামজাদা জমিদারকে সাদরে বরণ করলেন আমির মোহাম্মদ। আতিথ্যেরও কোনো ত্রুটি রাখলেন না। নানা কথার পর মনু মিয়া তাঁর অভিপ্রায় জানালেন সওদাগরের কাছে। মালকাকে বিয়ে করতে চান তিনি।

এমন প্রস্তাবে খুশিই হলেন মালকার বাবা আমির। কিন্তু বাদ সাধল মালকা নিজেই। বালিকা বিয়েতে রাজি নয়। কিন্তু কেন এই অসম্মতি? মনু মিয়া জানতে চাইলে মালকা উত্তরে বলে, ভয়াল শঙ্খ নদ পার হয়ে নৌপথে মনু মিয়ার দেশে সে যেতে পারবে না। নদীতে বাঁধ দিতে পারলে বিয়ে হবে। সড়কপথেই সে যাবে শ্বশুরবাড়ি।

এমন কঠিন শর্ত পূরণ করা এককথায় অসম্ভব। মালকা সরাসরি না বলতে পেরেই হয়তো এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু কে জানত, মনু মিয়া সেই শর্তই পূরণ করতে নেমে পড়বেন। তা–ও এক বালিকার কথায়।

মালকা বানু ও মনু মিয়ার প্রেমের উপাখ্যানে কোনো ট্র্যাজিক পরিণতি বা তোলপাড় করা হৃদয়াবেগ নেই। তবু চট্টগ্রামের এই কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে লোকগান, পালা, পুঁথি এমনকি চলচ্চিত্রও। ১৯৭৪ সালের ১৫ নভেম্বর মুক্তি পায় ফয়েজ চৌধুরী পরিচালিত শাবানা ও জাভেদ অভিনীত সাদা–কালো চলচ্চিত্র মালকা বানু। সুপারহিট এই চলচ্চিত্রের পুনর্নির্মাণ হয় করা ১৯৯১ সালে।

চলচ্চিত্রের নাম ছিল রঙিন মালকা বানু। কামরুজ্জামান পরিচালিত এই চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও চম্পা। এই চলচ্চিত্রও হয়েছিল ব্যবসাসফল। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে মূল কাহিনি বদলে যায় একেবারে। মনু মিয়াকে দেখানো হয় মজলুম, নিপীড়িত এক প্রেমিক হিসেবে। কিন্তু প্রচলিত কাহিনি মোটেও এমন নয়।

মনু মিয়াবৃত্তান্ত

তবে কে ছিলেন মনু মিয়া? তাঁর এমন সাদামাটা প্রেমকাহিনি কেনই–বা যুগ যুগ ধরে এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। গবেষক শামসুল আরেফীনের মতে, মনু মিয়া ও মালকা বানুর কাহিনি টিকে থাকার পেছনে রয়েছে এই ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত গীত ও পালা। চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে বিয়ের অনুষ্ঠানে নারীরা মালকার গীত গেয়ে শোনান। প্রখ্যাত ইতিহাস–গবেষক ড. আবদুল করিম রচিত বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য বইয়ে মনু মিয়া ও মালকা বানুর প্রেম নিয়ে রচিত এই গীতের কিছু অংশ পাওয়া যায়। এর কয়েকটি লাইন এমন:

‘জলদী থানার মাঝেরে, এক সদাইগর রে

সেই না সদাইগরের কন্যা নামে মালকা বানুরে।

মালকা বানুর সাত ভাই, অভাইগ্যা মনু মিয়ার কেহ নাই

মালকার বিয়া হইব মনু মিয়ার সাথেরে।

 (সংক্ষেপিত)

দু–দুটি চলচ্চিত্রের কল্যাণে মালকা বানু-মনু মিয়ার গান জনপ্রিয়তা পায়। মূলত এই গানের বদৌলতেই মানুষের আগ্রহ জাগে মালকা বানু ও মনু মিয়ার কাহিনি নিয়ে। তবে মনু মিয়া কেবলই লোককাহিনির চরিত্র ছিল না। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার শোলকাটা গ্রামে এখনো তাঁর নির্মিত মসজিদ রয়েছে। আর মালকা বানুর স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নে। এখানে রয়েছে মালকা বানুর মসজিদ ও দিঘি। প্রচলিত নানা কাহিনি ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, মালকা বানু ছিলেন মনু মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর প্রথম স্ত্রী খোরসা বানুর কোনো সন্তান ছিল না।

মনু মিয়ার পণ

বালিকা মালকা মনু মিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নদীতে নৌকায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবেন না বলে। মনু মিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রমত্তা শঙ্খে বাঁধ দিয়ে তিনি বালিকা মালকার মন রাখবেন।

যে কথা, সেই কাজ। শঙ্খে বাঁধ দিয়ে মনু মিয়া তাঁর বালিকা বধূকে নিয়ে গেলেন শঙ্খের অপর পারে আনোয়ারায়। এর আগে অনুষ্ঠিত হলো এক জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে। হিরে, জহরত, মণি–মুক্তা দিয়ে সাজানো হলো মালকা বানুকে। রচিত হলো বহু গান ও পালা।

এর মধ্যে ‘মালকা বানুর দেশে রে, বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজে রে’ গানটি এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। তবে মালকা ও মনু মিয়ার দাম্পত্য সুখের হয়নি। সে ঘরেও জন্মায়নি কোনো সন্তান। জমিদার মনু মিয়ার মৃত্যুর পর মালকা বানু বাবার বাড়িতে চলে আসেন। সেখানেই থাকেন আমৃত্যু।