ক্রাউড ফান্ডিং: ৯৮ লাখ টাকা চেয়ে ৬৯ লাখ পেয়ে গেছেন রাওয়ান সায়েমা

২০২২ সালে নির্মাতা রুকাইয়া জাহান চমকের শর্ট ফিল্মে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার সময়
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যের জোয়ান গার্নার (জো নামে পরিচিত) গয়না আর ধাতব পদার্থের ওপর স্নাতকোত্তর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজের সামর্থ্য ছিল না। ২০১৫ সালে জো নিজের পড়াশোনার জন্য ‘ক্রাউড ফান্ডিং’ করে তহবিল সংগ্রহের জন্য প্রচার শুরু করেন। তহবিল সংগ্রহে নেমে কেন গয়না নকশা নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে চান, সে বিষয়ে তাঁকে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে বিস্তর। ২০১৮ সালের বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, লন্ডনে জোর এখন নিজের একটি ল্যাব হয়েছে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নানা নকশার গয়না বানান। সেই জোয়ান গার্নারের সঙ্গেই যেন বাংলাদেশের মেয়ে রাওয়ান সায়েমার মিল রয়েছে।

দিনাজপুরের মেয়ে রাওয়ান সায়েমা বিশ্বের খ্যাতনামা ফিল্ম স্কুল আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটে (এএফআই) সিনেমাটোগ্রাফি বিষয়ে পড়তে যেতে চান। এখানে যাঁরা পড়ার জন্য আবেদন করেন, তাঁদের ১ শতাংশেরও কম সুযোগ পান। রাওয়ান এখানে আবেদন করে টিকে গেছেন। সেখান থেকে ২০ লাখ টাকার বৃত্তিও পেয়েছেন। কিন্তু স্বপ্নপূরণের জন্য আরও প্রায় ৯৮ লাখ টাকা দরকার তাঁর। এত টাকার কথা শুনে প্রথম দিকে দমে গেলেও পরে রাওয়ান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ক্রাউড ফান্ডিং বা জনবিনিয়োগের জন্য আবেদন করেন।

২০১৪ সালে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি শর্ট ফিল্ম উৎসবে সেরা সিনেমাটোগ্রাফারের পুরস্কার পাওয়ার পর
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগে স্নাতক করা রাওয়ান সায়েমা অর্থসহায়তার ওই আবেদনে সাড়া পেয়েছেন। তবে একই সঙ্গে অনলাইনে হেনস্তা বা বুলিংয়ের শিকারও হচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পেতে চাচ্ছেন!
গত বুধবার রাতে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন রাওয়ান। কেন অর্থসহায়তা চাচ্ছেন, তা জানিয়ে গত ১৬ জুলাই ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি।

এরপর থেকে আজ সোমবার পর্যন্ত সহায়তার ৬৯ লাখ টাকা তাঁর হাতে চলে এসেছে। বাবার দেওয়া ও নিজের সংগ্রহ মিলিয়ে তাঁর হাতে আছে কয়েক লাখ টাকা। আর ১৫ লাখ টাকা হলেই প্রয়োজনীয় তহবিল হয়ে যাবে।

রাওয়ান জানান, ব্র্যাক ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের সহায়তা পেয়েছেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী চিকিৎসক দিয়েছেন ২৪ লাখ টাকা।

তাঁর সহায়তার আবেদনটি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন রাওয়ান সায়েমা। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, এত বড় অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ হবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু মানুষ যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তাতে এখন তিনি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।
১১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য দাঁড়াবেন রাওয়ান। বাকি টাকাও এর মধ্যেই সহায়তা হিসেবে পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।

ক্রাউড ফান্ডিং ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি

নারীর ওপর সহিংসতা নিয়ে রাওয়ান সায়েমার তৈরি করা একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয় গত এপ্রিলে নেপালে। সেখানে কথা বলেন বাংলাদেশি এই তরুণ নির্মাতা
ছবি: সংগৃহীত

অনেকেই জানতে চান, কী এই ক্রাউড ফান্ডিং? কেতাবি ভাষায় ক্রাউড ফান্ডিং হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে অনলাইন ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে জনমানুষের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করার উদ্যোগ। নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে বড় কোনো ব্যবসায়িক বা সামাজিক কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর প্রধান উদ্দেশ্য। ব্যবসা বা সামাজিক কাজের জন্য বন্ধু, পরিবার, পরিচিত ব্যক্তি, ভোক্তা, পৃথক বিনিয়োগকারীরা এতে সহায়তা করেন। রাওয়ানের ক্রাউড ফান্ডিং উদ্যোগে সহায়তা হিসেবে তাঁর এক খালা দিয়েছেন এক লাখ টাকা। নাম প্রকাশ না করে কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী পাঠিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। এভাবেই চলছে তাঁর তহবিল সংগ্রহের কাজ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে কার্যক্রম প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় অনেক কম। সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে ‘একদেশ’ নামে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি ক্রাউড ফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে সাফল্যের গল্প খুব একটা শোনা যায় না। তবে এবার সিলেটে বন্যার সময় ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা তুলে বন্যাকবলিত ব্যক্তিদের সহায়তা করতে পেরেছেন।

২০১৯ সালের ২ অক্টোবর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে ‘ক্রাউড ফান্ডিং এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এ বিষয়ে কথা বলেন। সেখানে বলা হয়, ক্রাউড ফান্ডিং এমন একটি উদ্যোগ, যাতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বৃহৎ–সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে অল্প অল্প করে পাওয়া অর্থের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ এটি হচ্ছে জনসহযোগিতাভিত্তিক বিকল্প একটি আর্থিক ব্যবস্থা।

হেনস্তার শিকার রাওয়ান

রাওয়ান তাঁর ক্রাউড ফান্ডিং প্রচেষ্টা নিয়ে বলেন, ফেসবুকে পোস্ট শেয়ার করার পর থেকে অধিকাংশ মানুষ তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। অনেকেই ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ সহায়তা করে পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তবে কারও কারও কাছ থেকে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। একজন নারী হয়ে সিনেমাটোগ্রাফার হওয়ার স্বপ্ন দেখাকে তাঁরা স্বাগত জানাতে পারছেন না। বিশেষ করে নিজের সামর্থ্য না থাকার পরও কেন এমন স্বপ্ন দেখার সাহস করলেন, তা নিয়েই তাঁদের মূল আপত্তি। তাই অনেকেই আগেভাগেই বলে দিচ্ছেন, ভিসা হবে না। তাই স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়ে যাঁরা সহায়তা করছেন, তাঁদের টাকা কীভাবে ফেরত দেবেন, তা নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন।

রাওয়ান ডেন্টালে পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু তিনি বেছে নেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ। গত ১০ বছর সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং, সাউন্ড ডিজাইনসহ সিনেমার নানা অঙ্গনে কাজ করেছেন। এখন শুধু সিনেমাটোগ্রাফিকেই বেছে নিয়েছেন। ২০টির বেশি ফিকশন প্রজেক্টে সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করেছেন তিনি। ৯ পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘ন-বর্গীয় আবেগ’, ফিচার ফিল্মের স্ক্রিপ্ট, সরকারি অনুদান পাওয়া শর্ট ফিল্ম ‘দ্য লেডি ল্যান্ড’, জডোরোস্কির সব সিনেমার সাইকো-বিশ্লেষণ করে লেখা প্রায় ৮০ পাতার গবেষণাপত্রের (বই আকারে প্রকাশযোগ্য) স্বত্ব বিক্রি করতে চাইছেন তিনি। এগুলোর বিনিময়ে তিনি আর্থিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসার জন্য তাঁর পোস্টে আহ্বান জানান।

পাশে দাঁড়িয়েছে কয়েকটি সংস্থা

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও আইপিডিসিসহ বড় কয়েকটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান রাওয়ানকে সহায়তায় এগিয়েও এসেছে। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ ২ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, সাধারণত এ ধরনের ব্যক্তিগত তহবিল গঠনে অংশ না নিলেও রাওয়ানের বিষয়টি ব্যতিক্রম বলেই তিনি অংশ নিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিজে ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করবেন এবং বন্ধু-স্বজনদেরও বলছেন সহায়তা করতে। কেননা, সিনেমাটোগ্রাফার হওয়ার এমন ‘দুঃসাহস’ আগে কোনো মেয়ে দেখিয়েছেন বলে মনে হয় না।

ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেন রাওয়ান সায়েমা
ছবি: সংগৃহীত

আসিফ সালেহ প্রথম আলোকে আরও বলেন, ক্রাউড ফান্ডিং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্যোগ, চিকিৎসা, অর্থাৎ প্রাণ রক্ষার্থে চাওয়া হয়। রাওয়ান চেয়েছেন তাঁর সিনেমাটোগ্রাফার হওয়ার স্বপ্নপূরণের জন্য। জীবনে অনেক লড়াই করার পরও এত বড় স্বপ্ন দেখার সাহস করেছেন। স্বপ্নপূরণের সুযোগও পেয়েছেন। এখন শুধু টাকার জন্য আটকে গেলে তা মেনে নেওয়াটা কঠিন হবে। এর আগে পর্বতারোহী ওয়াসফিয়া নাজরীনের একটি পর্বতে চড়ার সময় পাশে দাঁড়িয়েছিল ব্র্যাক। ওয়াসফিয়াকে নিয়ে এখন দেশ গর্ব করে। একইভাবে রাওয়ানের জন্যও ১০ লাখ টাকা দিচ্ছে ব্র্যাক। অনেকেই নিজে আর্থিক সহায়তা দিতে না পারলেও ফেসবুকে রাওয়ানের পোস্টটি শেয়ার করে অন্যদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন।

মাত্র ১৩ বছর বয়সে রাওয়ানের মা মারা গেছেন। বড় হয়েছেন বাবা ও ভাইয়ের কাছে। বাবা রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ দিনাজপুরের একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বর্তমানে অবসরে আছেন। থাকছেন রাজশাহীতে। বাবা নিজে মেয়ের স্বপ্নপূরণে একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। আর এবার দিয়েছেন চার লাখ টাকা। বড় ভাই ব্যবসায়ী, পরিবার নিয়ে থাকেন জয়পুরহাটে।

রাওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যে স্বপ্ন দেখছি, তা পূরণ করার জন্য যে টাকার প্রয়োজন, তা বাবার কাছে নেই। মার্চ মাসে প্রথম জানতে পারি, আমি এএফআইয়ে চান্স পেয়েছি। তিন মাস শুধু ভেবেছি। তারপর ক্রাউড ফান্ডিংয়ের জন্য পোস্ট দিই। কিছু মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন, তা আমি জানি। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো সমস্যা নেই।’

রাওয়ান বলেন, তাঁর এই স্বপ্ন পূরণ হলে এক কোটি টাকা আয় করা হয়তো তেমন কোনো কঠিন কাজ হবে না। যাঁরা সাহায্য করছেন, তখন তাঁদের টাকা ফেরত দিতে পারবেন। কেউ টাকা ফেরত নিতে না চাইলে তাঁদের আশ্বস্ত করতে চান যে, তিনি ভালো কাজ দিয়ে তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন। সেখানে যা শিখবেন, দেশে ফিরে তরুণদের তা শেখাতে পারবেন।

রাজিব আহমেদ বললেন, বাংলাদেশে এখনো ক্রাউড ফান্ডিং সাধারণত সামাজিক সমস্যার সমাধান বা মানবিক সাহায্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফেসবুক পেজ–নির্ভর তরুণ উদ্যোক্তাদের (যাঁদের বিশাল অংশ নারী) আর্থিক সাহায্য পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাঁদের জন্য ক্রাউড ফান্ডিং অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে যত দ্রুত সম্ভব ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে সরকারি নীতিমালা এবং সম্ভব হলে আইন তৈরি হওয়া দরকার। আর বিষয়টি তত্ত্বাবধান করার জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা না করলে এ খাতে প্রতারণা, জালিয়াতি হলে তা মোকাবিলা করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

রাওয়ান তাঁর পোস্টে লিখেছেন, কেউ তাঁকে যদি আর্থিক সহায়তা করতে না চান, তাহলে সুদ ছাড়া ঋণ দিতে পারেন। পড়াশোনা শেষের পর তিনি এ ঋণ পরিশোধ করে দেবেন। কোনো ব্যক্তি বা ব্যাংক শিক্ষাবৃত্তি দিতে পারেন। কেউ চাইলে ভবিষ্যতের জন্য তাঁকে আগাম কাজের জন্য ঠিক করতে পারেন। আর যাঁরা বিশ্বাস করেন, সিনেমাটোগ্রাফির জায়গাটা শুধু পুরুষের নয়, তাঁরাও একজন নারীর পাশে দাঁড়াতে পারেন।