সেই গুড়ের জিলাপি, এই রেশমি জিলাপি

বরিশাল নগরের বাজার রোডের একটি মিষ্টির দোকানে ভাজা হচ্ছে রেশমি জিলাপিসহ নানা ধরনের জিলাপি। প্রতি কেজি রেশমি জিলাপির দাম ৩০০ টাকাছবি: সাইয়ান

পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে বরিশাল অঞ্চলে গৃহস্থ বাড়িতে মুড়িভাজার ধুম পড়ত। সেই মুড়ি সংরক্ষণ করা হতো টিনের বাক্সে। এই মুড়িই ছিল ইফতারের প্রধান অনুষঙ্গ। মুড়ি বেটে গুঁড়া করে গুড় দিয়ে মুঠো করে মোয়া, মলিদা—কত–কী তৈরি হতো। আবার গুড় দিয়ে মুড়ি, গুড়ের জিলাপি দিয়ে মুড়ি, ইফতারিতে এভাবেই ব্যবহার করা হতো মুড়ির।

এসব চালু ছিল আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এখন ইফতারিতে মলিদা, মুড়ি–গুড়ের মুঠো মোয়া, গুড়ের জিলাপি অনেকটা হারিয়ে গেলেও এখন যোগ হয়েছে হরেক রকমের জিলাপি। এর মধ্যে রেশমি জিলাপির জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি।

ষাটের দশকে কিশোর ছিলেন বরিশাল নগরের সামজিক আন্দোলনের নেতা দেওয়ান আবদুর রশিদ। ইফতারি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। বললেন, সেই সময়ের ইফতারির সঙ্গে আজকের ইফতারির অনেক পার্থক্য।

সে সময় চালভাজার গুঁড়া আর গুড় পানির সঙ্গে মিলিয়ে ইফতারের প্রচলন ছিল। থাকত মলিদা, মুড়ি, চিড়া। আর গ্রামে পান্তাভাত, লবণ আর পানি অথবা ভেজানো চিড়া আর গুড়ের পানি। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে তৈরি হতো ভেজানো পিঠা। রোজা সামনে রেখে মুড়িভাজার ধুম পড়ত। বাজারে তখন চিনি আর আখের গুড়ের জিলাপি পাওয়া যেত। চিনির দাম বেশি থাকায় গুড়ের জিলাপির কদর ছিল বেশি।

সত্তরের দশকে নগরের বটতলা এলাকার বাসিন্দা রফিকুল আলমের বয়স ছিল ১৬ বছর। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘তখন বাজার রোডে অনেকগুলো মিষ্টির দোকান ছিল। সেখান থেকে আমরা গুড়ের জিলাপি কিনে আনতাম। এখন গুড়ের জিলাপি তো বিলুপ্ত।’

বরিশালে ‍মূলত ইফতারিতে রুচির পরিবর্তন শুরু হয় আশির দশকের শেষ দিকে। ওই সময় যোগ হয় ছোলা ও পেঁয়াজু। সেটাও ছিল শহরকেন্দ্রিক। তখন শহরের রাস্তার পাশে ছোট ছোট টেবিল বসিয়ে মৌসুমি কিছু ব্যবসায়ী এসব বিক্রি করতেন। নব্বইয়ের দশক থেকে ধীরে ধীরে ইফতারিতে আইটেমের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০০০ সালের শুরুতে এর আরও বিস্তৃতি ঘটে। আস্তে আস্তে ইফতারিতে যোগ হতে থাকে নানা ব্যঞ্জন, বিশেষ করে পুরান ঢাকার পদগুলো—বেগুনি, আলুর চপ, ডিমের চপ, চিকেন ও বিফ আখনি, খিচুড়ি, হালিম, শাহি জিলাপি, ছোট জিলাপি, বুরিন্দা, চিকেন টিকিয়া, কাবাব, রেশমি কাবাব, বিফ চাপ, বটি কাবাব, বিরিয়ানি, তেহারি, দই-চিড়া, পাটিসাপটা পিঠা, লাচ্ছি, ফিরনি, ফালুদা, কালাভুনা আরও কত কি।

ফুটপাতে টেবিল বসিয়ে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের ইফতার সামগ্রী। বরিশাল নগরের পুলিশ লাইন রোডে
ছবি: প্রথম আলো

নগরের সদর রোড, বাংলাবাজার, লঞ্চঘাট, বাজার রোড, বগুড়া রোড, বটতলা, চৌমাথা, পুলিশ লাইনস রোডসহ কয়েকটি এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের অস্থায়ী দোকান ঘুরে দেখা গেল, এসব দোকানে নানা পদ নিয়ে ইফতারির পসরা সাজিয়েছেন দোকানিরা। বিকেল হলেই ভিড় লেগে থাকে দোকানগুলোয়। সন্ধ্যার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায় সব।

নগরের নাজেমস, আরাবেল্লা, লেক ভিউ, হান্ডি কড়াই, হট প্লেট, তাওয়া, জাফরান, হুমাহুম, রিভার ক্যাফে, রয়েল, কাচ্চি ডাইন, ইউরো ক্যাফে, আকাশসহ বেশ কিছু নতুন-পুরোনো ও অভিজাত রেস্তোরাঁর দখলে রয়েছে ইফতারি বাজারের অনেকটা। এসব রেস্তোরাঁয় খুচরার পাশাপাশি বেসিক, প্লাটিনাম, প্রিমিয়ামসহ নানা নামে প্যাকেজ ইফতারি বিক্রি হচ্ছে।

রূপাতলী এলাকায় ইফতারি কিনতে আসা ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বললেন, বাড়িতে ছোলা, পেঁয়াজু, শরবত, জুস, চপ তৈরি হয়। কিন্তু এরপরও বাইরের রেস্তোরাঁর বিশেষ কিছু পদের প্রতি আগ্রহ থাকে সবার। এ জন্য প্রতিদিন বাইরে থেকে কিছু কিনতে হয়। এবার ইফতারির সব পদেরই দাম বেশি, তবে রেশমি জিলাপির প্রতি পরিবারের সবার ভিন্ন রকমের আগ্রহ। তাই আইটেমটি বাইরে থেকে কিনতে হয়।

নগরের বাজার রোডে কয়েকটি মিষ্টির দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার এসব দোকানে রেশমি জিলাপির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। চিকন, ঝুরঝুরে, টাটকা এই জিলাপির এতই চাহিদা যে বিকেলের মধ্যেই দোকানগুলোয় পদটি শেষ হয়ে যায়। বাজার রোডের নিউ হালাল সুইটস নামে একটি মিষ্টির দোকানের মালিক আল আমিন জানালেন, প্রতিদিন তাঁর দোকানে ৬০ থেকে ১০০ কেজি রেশমি জিলাপি বিক্রি হয়। প্রতি কেজির দাম ৩০০ টাকা। অপর দিকে সাধারণ জিলাপি ১৫০ টাকা।

রেশমি জিলাপির চাহিদা এত বেশি যে অনেক সময় বিক্রেতারা চাহিদামতো দিতে পারেন না। রেশমি জিলাপি তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে ময়দা, পোলাওয়ের চালের গুঁড়া, মাল্টা, খাঁটি ঘি, চিনি ও সয়াবিন তেল। বরিশালের থ্রিএস পেস্ট্রির প্রধান কারিগর ফোরকান ফকির গতকাল বিকেল প্রথম আলোকে বলেন, রেশমি জিলাপি সাধারণ জিলাপির চেয়ে আকারে ছোট, চিকন ও ঝুরঝুরে। এই জিলাপি অনেক মচমচে হয়, সাধারণ আকৃতির জিলাপিকে মচমচে করাটা কঠিন।