করোনায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩ লাখের বেশি মৃত্যু 

মহামারির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে মৃত্যু বেড়েছে। এই ধরনের গবেষণা ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন।

করোনাভাইরাসফাইল ছবি রয়টার্স

কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম দুই বছর দেশে স্বাভাবিক বছরগুলোর তুলনায় মৃত্যু বেশি হয়েছে। কোভিডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার বেশি মৃত্যু হয়েছে। গত সাত দশকের মৃত্যুর ধারা পর্যালোচনা করে এই বেশি মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করেছেন গবেষকেরা। মহামারি না হলে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি হতো না। মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণে গড় আয়ু কমেছে ১ দশমিক ৪ বছর।

মহামারির সময় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সরাসরি মানুষ মারা গেছেন। এটি প্রত্যক্ষ কারণ। মহামারির সময় অন্য রোগের চিকিৎসা নিতে অনেক মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হননি, জরুরি চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যাননি, মানুষ চিকিৎসাকেন্দ্র খোলা পাননি, হাসপাতাল খোলা থাকলেও স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া যায়নি, অনেক সময় হাসপাতালে চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ বন্ধ ছিল—এসব পরোক্ষ কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অতিরিক্ত মৃত্যু নিয়ে এই গবেষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল অঙ্গরাজ্যের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশন। এই প্রতিষ্ঠান এক দশকের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ে নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করে আসছে। তাদের মূল উদ্যোগটি ‘বৈশ্বিক রোগ ও জখমের বোঝা এবং ঝুঁকি বিষয়ে গবেষণা’ বা জিবিডি নামে পরিচিত। বর্তমান গবেষণায় ১৯৫০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এসব দেশের মানুষের বয়স ও লিঙ্গভিত্তিক মৃত্যুহার, প্রত্যাশিত আয়ু, অনুমিত জনসংখ্যা এবং কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব স্থান পেয়েছে। ১১ মার্চ ৮৭ পৃষ্ঠার গবেষণাটি প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট। এই গবেষণায় অর্থায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।

করোনার প্রথম দুই বছরে কত মৃত্যু হয়েছে এবং অন্য সময়ে সম্ভাব্য সব কারণে কত মৃত্যু হয়, এই দুইয়ের বিয়োগফল থেকে বাড়তি মৃত্যুর সংখ্যা গবেষকেরা বের করেছেন। বিশ্বে ১ কোটি ৫৯ লাখ বেশি মৃত্যু হয়েছে। 

২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হয়। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু হয়। সরকারি হিসাবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত করোনায় ২০ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪৯৩ জন। এটাই করোনার কারণে প্রত্যক্ষ মৃত্যু। বাকি তিন লাখের মতো মৃত্যু হয়েছে পরোক্ষ কারণে। অবশ্য পরোক্ষ কারণে কত মৃত্যু হয়েছে, এমন তথ্য সরকারি কোনো পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় না।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামারির প্রথম বছরে আমার পরিচিত হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত এক ব্যক্তি ভয়ে হাসপাতালে যাননি, বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। ওই সময় জরুরি সেবা অনেকে পাননি, অনেকে জানতেন না জরুরি সেবা নিতে কোথায় যেতে হবে। এসব কারণে মৃত্যু বেড়েছে।’

গবেষকেরা বলছেন, গত সাত দশকে মৃত্যু ক্রমাগত কমেছে। এই ধারা দেখা গেছে, ১৯৫০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। ২০২০ ও ২০২১ সালে দেখা গেছে, মৃত্যুর ধারা বিপরীতমুখী, অর্থাৎ মৃত্যু বাড়ছে।

কী পদ্ধতিতে জানা গেল

গবেষকেরা ১৯৫০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২০৪ দেশ ও অঞ্চল এবং ৮১১টি উপ-অঞ্চলের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণের জন্য তাঁরা ২২ হাজার ২২৩টি তথ্য সূত্রের সাহায্য নিয়েছেন। এর মধ্যে ছিল জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন, নানা ধরনের জরিপ, জনশুমারি এবং অন্যান্য সূত্র। বিশ্লেষণের সময় প্রজনন হার, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুহার, নির্দিষ্ট বয়সভিত্তিক মৃত্যু বোঝার জন্য নির্দিষ্ট মডেল ব্যবহার, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে মৃত্যুর তথ্য এবং করোনার কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মৃত্যুর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি জনসংখ্যার অনুমিত সংখ্যা নেওয়া হয়েছে।

করোনার প্রথম দুই বছরে কত মৃত্যু হয়েছে এবং অন্য সময়ে সম্ভাব্য সব কারণে কত মৃত্যু হয়, এই দুইয়ের বিয়োগফল থেকে বাড়তি মৃত্যুর সংখ্যা গবেষকেরা বের করেছেন। বিশ্বে ১ কোটি ৫৯ লাখ বেশি মৃত্যু হয়েছে। 

গবেষকেরা বলছেন, গত সাত দশকে মৃত্যু ক্রমাগত কমেছে। এই ধারা দেখা গেছে, ১৯৫০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। ২০২০ ও ২০২১ সালে দেখা গেছে, মৃত্যুর ধারা বিপরীতমুখী, অর্থাৎ মৃত্যু বাড়ছে। বয়সভিত্তিক বিভাজনে দেখা যায়, শুধু পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু আগের মতোই কমছে। অন্য সব ক্ষেত্রে (১৫ বছরের কম বয়সী, ১৫-৬৪ বছর এবং ৬৫ বছর ও তার বেশি বয়সী) মৃত্যু বাড়তে দেখা গেছে।

করোনায় মৃত্যুর প্রভাব পড়েছে প্রত্যাশিত গড় আয়ুর ওপর। ১৯৫০ সাল থেকে বৈশ্বিক গড় আয়ু ক্রমাগত বেড়েছে। তবে ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২১ সালে বৈশ্বিক গড় আয়ু ১ দশমিক ৬ বছর কম দেখা গেছে।

ল্যানসেট বলছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে ৩ লাখ ৩২ হাজার অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছিল।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি

গবেষকেরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানার জন্য ১৯৫০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭টি জনশুমারি প্রতিবেদন, বিভিন্ন সময় হওয়া বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ, মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে, ফার্টিলিটি সার্ভে, ভাইটাল রেজিস্ট্রেশনসহ আরও কিছু জরিপের তথ্য ব্যবহার করেছেন। ল্যানসেট–এর প্রবন্ধে বলা হয়েছে, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের মতো কারণে কিছু কিছু এলাকা বা দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার কথাও উল্লেখ আছে।

গবেষকেরা বলছেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশে সব বয়সী মোট ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার ছিল অতিরিক্ত মৃত্যু। মহামারি যদি না হতো তাহলে মৃত্যু হতো ৯ লাখ ২০ হাজার মানুষের। 

অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭০ হাজার ৪৮২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। গবেষকদের ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে কিছু পার্থক্য আছে। ল্যানসেট বলছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে ৩ লাখ ৩২ হাজার অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছিল।

গবেষণা প্রবন্ধের উপসংহারে বলা হয়েছে, দীর্ঘ মেয়াদে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব কী পড়েছে, তা মূল্যায়ন করতে হলে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে মৃত্যুহার, গড় আয়ু, জনসংখ্যা এসব ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন হয়েছিল, তা জানা জরুরি। বহুদিন মৃত্যু কমে আসার এবং গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার যে ধারা চলে আসছিল, মহামারি তা পাল্টে দিয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৭৩ দশমিক ৭ বছর। ২০২১ সালে গড় আয়ু কমে হয় ৭২ দশমিক ৩ বছর। অর্থাৎ দুই বছরে গড় আয়ু কমে ১ দশমিক ৪ বছর।

জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, ‘মহামারি নিয়ে এই ধরনের গবেষণা ও বিশ্লেষণ আমাদের নেই। ভবিষ্যতে মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য এ ধরনের তথ্য আমাদের দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, জরুরি পরিস্থিতিতে যেন অতিরিক্ত মৃত্যু না হয়।’