ঘূর্ণিঝড় মোখা: দুই সমুদ্রবন্দরে মহাবিপৎসংকেত, জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা

ঘূর্ণিঝড় মোখা সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ ও কক্সবাজারের বিভিন্ন উপকূলে আঘাত হানতে পারে। তাই সমুদ্র থেকে তীরে নোঙর করে রাখা হয়েছে সারি সারি নৌকা। আরও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে নৌকাগুলো টেনে ওপরে তুলছেন জেলেরা। গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় টেকনাফ সমুদ্রসৈকত এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আজ শনিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার ও এর কাছাকাছি উপকূলীয় এলাকায় এই ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব পড়তে পারে। আর আগামীকাল রোববার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে এটি কক্সবাজার ও উত্তর মিয়ানমারের উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসায় আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল শুক্রবার রাত নয়টায় এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলেছে। উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও ভোলা জেলা ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পাশাপাশি এই দুই জেলার কাছাকাছি যেসব দ্বীপ ও চর রয়েছে, সেসব দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুটের বেশি উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার অংশ হিসেবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় ১০ লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় দিতে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে গতকাল সকাল থেকে কয়েক শ মানুষ কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছেড়েছেন।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গতকাল রাত ১১টা থেকে কক্সবাজারের মহেশখালীর দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর ফলে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে আজ গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হবে।

পাঁচ থেকে সাত ফুট জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা

রাতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে (১২ নম্বর) বলা হয়, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি এলাকায় থাকা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে রোববার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে কক্সবাজার-উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এর আগে আজ সন্ধ্যা থেকে কক্সবাজার ও এর কাছাকাছি উপকূলীয় এলাকায় মোখার অগ্রভাগের প্রভাব দেখা যেতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও ভোলা এবং এসব জেলার কাছাকাছি দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা সংকেত জানিয়ে সেন্ট মার্টিন জেটি ঘাটে পতাকা তুলছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। আজ শুক্রবার বিকেলে সেন্ট মার্টিন জেটিঘাট এলাকার থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ সতর্কতা

ঘূর্ণিঝড় মোখার সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যালার্ট-৪’ জারি করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর গত রাত নয়টায় তিন সমুদ্রবন্দরের জন্য ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করার পরই এই সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়।

অ্যালার্ট-৪ জারি করার অর্থ কী জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, এই সতর্কতা জারির অর্থ হলো ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলায় বন্দর জেটি থেকে সব জাহাজ সাগরে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা। বন্দরে জোয়ারের সময় সাগর থেকে জেটিতে জাহাজ আনা-নেওয়া হয়। ভোর চারটায় (শনিবার) জোয়ার শুরু হবে। তখনই সব জাহাজ সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর ছোট জাহাজগুলো কর্ণফুলী নদীর উজানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানো ও চত্বর থেকে খালাসের কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বন্দরে নিয়ন্ত্রণকক্ষও খোলা হয়েছে।

জেটি থেকে কেন জাহাজ সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব বলেন, বড় জাহাজগুলো জেটিতে থাকলে ঢেউয়ের কারণে জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে সাগরে জাহাজগুলো ইঞ্জিন চালু রেখে ঢেউ বা ঝড়ের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে ভাসতে পারে। এ জন্য দুর্ঘটনা এড়াতে বড় জাহাজগুলো সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বন্দর কর্মকর্তারা জানান, মূলত দুর্যোগ মোকাবিলায় কখন কী করতে হবে, তা ঠিক করতে বন্দরের নিজস্ব প্রস্তুতির জন্য এই সতর্কতা জারি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৯৯২ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রণীত ঘূর্ণিঝড়-দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী, আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংকেত অনুযায়ী চার ধরনের সতর্কতা জারি করে বন্দর।

বন্দর কর্মকর্তারা জানান, আবহাওয়া অধিদপ্তর ৩ নম্বর সংকেত জারি করলে বন্দর প্রথম পর্যায়ের সতর্কতা বা ‘অ্যালার্ট-১’ জারি করে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ৪ নম্বর সংকেত জারি করলে বন্দর অ্যালার্ট-২ জারি করে। বিপৎসংকেত ৫, ৬ ও ৭ নম্বরের জন্য বন্দরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা অ্যালার্ট-৩ জারি করা হয়। মহাবিপৎসংকেত ৮, ৯ ও ১০ হলে বন্দরেও সর্বোচ্চ সতর্কতা বা অ্যালার্ট-৪ জারি করা হয়। সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি হলে বন্দর জেটিতে অবস্থানরত জাহাজগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

সরকারের প্রস্তুতি

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি সম্পর্কে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ১ হাজার ৬০৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ লাখ ৭ হাজার ১০০ জনকে আশ্রয় দেওয়া যাবে।

কক্সবাজার জেলার জন্য ৫৯০ মেট্রিক টন চাল, সাড়ে ৩ মেট্রিক টন টোস্ট বিস্কুট, ৩ মেট্রিক টন ড্রাই কেক, ২০ হাজার খাওয়ার স্যালাইন ও ৪০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই জেলায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) আওতায় ৮ হাজার ৬০০ জন ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ২ হাজার ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ২০ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে চট্টগ্রামের জন্য ১৪ লাখ ৮ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলাটিতে ৫৩০টি স্থায়ী ও ৫০০টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যেগুলোর ধারণক্ষমতা ৫ লাখ ১ হাজার ১১০ জন। এরই মধ্যে সিপিপির ৮ হাজার ৮৮০ জন ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

মোখা শক্তিশালী হয়ে উঠছে

মোখার সর্বশেষ গতিপ্রকৃতি নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার (আজ) সন্ধ্যার পর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল বা কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি হতে পারে। কক্সবাজার অঞ্চলে অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে। এখন পর্যন্ত যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি রোববার টেকনাফের দক্ষিণ দিক দিয়ে চলে যাবে।

আজিজুর রহমান বলেন, শুরুতে ঘূর্ণিঝড়ের এগোনোর গতি ছিল ঘণ্টায় ১৪ থেকে ১৫ কিলোমিটার, পরে তা ৮ কিলোমিটার হয়ে গেছে। এর মাধ্যমে মূলত এর শক্তি সঞ্চয় হয়েছে এবং হচ্ছে। ধীর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে মোখা।