• মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা সাংঘর্ষিক—এমন যুক্তিতে রিটটি করা হয়েছিল।

  • রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী জানিয়েছেন, চূড়ান্ত শুনানির জন্য রিটটি (রুল) শিগগিরই হাইকোর্টে উপস্থাপন করা হবে। রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছে, শুনানির জন্য তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। 

প্রতীকী ছবি

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২৫ ও ৩১) নিয়ে তিন বছর আগে হাইকোর্ট রুল দিয়েছিলেন। রুলে আইনের ওই দুটি ধারা কেন সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। সেই রুল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। 

 ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় ‘আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ’ করলে অপরাধ এবং সাজা সম্পর্কে বলা আছে। অন্যদিকে এই আইনের ৩১ ধারায় ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ইত্যাদি অপরাধ ও দণ্ডের’ বিষয়ে বলা আছে।

ওই দুটি ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একজন সাংবাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক ও পাঁচজন আইনজীবীসহ ৯ জন ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেন। রিট আবেদনকারী পক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় কোন কাজটি ভীতিকর, কোনটা আক্রমণাত্মক বা বিরক্তিকর, তা সুনির্দিষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করা নেই। একইভাবে এই আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী, ‘যদি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে’ বা যদি ‘অস্থিরতা তৈরি হয়’—এগুলো বলতে কী বোঝায় এবং এসবের সংজ্ঞাও সুনির্দিষ্ট করা নেই। আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি হচ্ছে, অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করতে হবে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওই দুটি ধারায় অপরাধগুলো সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। যে কারণে পছন্দ অনুযায়ী, যেকোনো ব্যক্তিকে হয়রানি করার সুযোগ রয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসংক্রান্ত সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদসহ কয়েকটি অনুচ্ছেদের (৭, ১১, ২৬, ২৭, ৩১ ও ৩২) সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা সাংঘর্ষিক—এমন যুক্তিতে রিটটি করা হয়।

আরও পড়ুন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল ছাড়া অপব্যবহার বন্ধ হবে কীভাবে

তিন বছর আগে রিটটি করা হয়। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুল দেন হাইকোর্ট।

রিট আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আব্দুল্লাহ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আসাদ উদ্দিন, আসাদুজ্জামান, জোবাইদুর রহমান, মহিউদ্দিন মোল্লা, মুজাহিদুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ ইসমাইল, কামরুজ্জামান ও রফিকুল ইসলাম। 

ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুল দেন। রুলে আইনসচিব এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। পরে রুলের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং সাইবার/ডিজিটাল অপরাধ চিহ্নিত, রোধ ও দমন করতে এই আইন। তথ্য ও কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের সুরক্ষা, বাক্স্বাধীনতা দমন না করতে, কিন্তু মিথ্যা সংবাদ ও গুজব থেকে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা এবং ডিজিটাল মিডিয়ায় মিথ্যা বা বক্তব্য ছড়ানো বন্ধে এই আইন করা হয়েছে। আইনটি হওয়ার আগপর্যন্ত হ্যাকিং ও তথ্য চুরির মতো ডিজিটাল অপরাধের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ছিল না। সহিংসতা সৃষ্টিতে মিথ্যা সংবাদ ও গুজব দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

দুটি ধারা নিয়ে করা এই রিট সর্বশেষ গত বছরের ১১ আগস্ট হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। আদালত রিট শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রিটের ওপর শুনানি শুরু হয়। তবে শুনানির এক পর্যায়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের এই দ্বৈত বেঞ্চ রিটটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। 

তখন ওই বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুনানি শুরুর এক পর্যায়ে শুনতে অপারগতা প্রকাশ করে আদালত রিটটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। আর রাষ্ট্রপক্ষ রুলের জবাবে বলেছে, সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আইনটি করা হয়েছে। এখন রিট আবেদনকারী পক্ষ চাইলে অন্য কোনো বেঞ্চে শুনানির জন্য পদক্ষেপ নিতে পারে। শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ প্রস্তুত আছে।

ধারা দুটিতে যা রয়েছে

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(১) ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি, ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত পাঠান, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত পাঠান, প্রকাশ বা প্রচার করেন। (খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর, বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। 

এই আইনের ২৫(২) ও ২৫(৩) ধারায় দণ্ড সম্পর্কে বলা আছে। ২৫(২) ধারা বলছে, যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর ২৫(৩) উপধারা বলছে, যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১(১) উপধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির অনুরূপ কাজ হবে একটি অপরাধ। 

এই আইনের ৩১(২) উপধারা বলছে, যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৭ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৩১(৩) উপধারা বলছে, যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা নিয়ে করা রিট আবেদনকারীদের অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির প্রথম আলোকে বলেন, ধারা দুটিতে অপরাধের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, এটি স্পষ্ট নয়, সুনির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ কোনটা বিরক্তিকর, কোনটিতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার সম্ভাবনা আছে, কোনটি ভীতিকর, কোনোটি অসত্য—এর সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা না থাকার কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এটিকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারছে। এমন প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই মূলত রিটটি করা হয়। পরে হাইকোর্ট রুল ইস্যু করেন। রাষ্ট্রপক্ষ রুলের জবাব দিয়েছে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে শুনানিও হয়েছিল। পরে অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে রিটটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বিষয়টির সঙ্গে বাক্‌স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত এবং এর অনেক অপব্যবহার হচ্ছে—এ জন্য রুল দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করা জরুরি। 

আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, হাইকোর্টের এখতিয়ার সম্পন্ন বেঞ্চে রিটটি শুনানির (রুল) জন্য শিগগিরই উপস্থাপন করা হবে। বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি হলে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে নাগরিকদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত হবে।