কর্মজীবী নারীদের জন্য নির্মিত ছয়তলা হোস্টেলটির বিদ্যুৎ–সংযোগের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তার চুরির ঘটনার পেরিয়ে গেছে ১৭ দিন। অথচ এখনো সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়নি। এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেছে হোস্টেলের সংরক্ষণ করা পানি। এখন রান্না ও গোসলের পানি আনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। মুঠোফোন চার্জ দিতেও বাইরে যেতে হচ্ছে। গাজীপুরের কালীগঞ্জের প্রীতিলতা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে এমন পরিস্থিতিতে রয়েছেন ২০ কর্মজীবী নারী।
আশপাশের শিল্পকারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের আবাসন সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রায় চার বছর আগে হোস্টেলটি নির্মাণ করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। এতে ব্যয় ১৭ কোটি টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাষ্য, হোস্টেলের আয় নেই, তাই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিচ্ছে না অধিদপ্তর। এমনকি হোস্টেলে তার চুরির ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সেটি লুকানোর চেষ্টা করছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। চুরির ঘটনা ঘটেছে ৪ জুলাই রাতে। ঘটনার ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি তাঁরা পুলিশকে জানাননি।
হোস্টেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, এখানে ১২৪ জন কর্মজীবী নারীর আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে থাকছেন মাত্র ২০ জন। ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কেউ এসে বেশি দিন থাকতে পারছেন না। বিষয়গুলো কর্মকর্তাদের জানানো হলেও বরাদ্দ নেই অজুহাতে এড়িয়ে যান তাঁরা। বিদ্যুৎ না থাকায় দুর্ভোগ এখন চরমে পৌঁছেছে।
এক বছর ধরে হোস্টেলে থাকছেন এমন এক নারী বলেন, ১৭ দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। অসহ্য গরমে বিদ্যুৎ ও পানি ছাড়া হোস্টেলে অবস্থান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। হোস্টেলের পাশের একটি মসজিদ থেকে পানি এনে জরুরি প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে। রান্নাসহ আনুষঙ্গিক সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টয়লেট ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যে তার চুরি হয়েছে, সেটি ভূগর্ভস্থ লাইনে ব্যবহৃত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন। হোস্টেলের সীমানাদেয়ালের বাইরে খুঁটি থেকে ভূগর্ভের ওপরের অংশের প্রায় ২০ ফুট তার চুরি করে চোর চক্র। এই তারের বাজারমূল্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কালীগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) রায়হান রাব্বি বলছেন, হোস্টেলের ভূগর্ভস্থ সংযোগে ব্যবহৃত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তার চুরি হয়েছে। এ ধরনের তার পল্লী বিদ্যুৎ সরবরাহ করে না। গ্রাহক কিনে দিলে তাঁরা সেটির সংযোগ দিয়ে দেন। হোস্টেল কর্তৃপক্ষ তার কিনে না দেওয়ায় সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কালীগঞ্জে কর্মজীবী নারী হোস্টেলের প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, হোস্টেলের আয় থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হবে। প্রকল্প শুরুর পর হোস্টেল থেকে প্রতি মাসে গড়ে আয় হয়েছে মাত্র ২০ হাজার টাকা। আর প্রতি মাসে ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালে শেষ হওয়ার পর হোস্টেল পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, প্রীতিলতা কর্মজীবী নারী হোস্টেলে চার শয্যাবিশিষ্ট একটি কক্ষে থাকতে একজন নারীর ব্যয় ৫০০ টাকা। তিন শয্যার কক্ষে ৭০০ টাকা এবং দুই শয্যার কক্ষে ৯০০ টাকা গুনতে হয় একজন নারীকে। অথচ এর চেয়ে অনেক কমে আশপাশে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে এই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সোমবার সরেজমিনে কালীগঞ্জের দেওপাড়া এলাকায় গিয়ে হোস্টেলে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও হোস্টেলে বসবাসকারী তিন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, ভবন নির্মাণ ও উদ্বোধন করেই দায় সেরেছে অধিদপ্তর। বরাদ্দ না থাকায় ১৬ মাস ধরে হোস্টেল সুপারসহ ১৮ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন–ভাতাও বন্ধ রয়েছে। হোস্টেলের দিবাযত্ন কেন্দ্রে কর্মজীবী নারীদের সন্তানদের জন্য ২০টি আসন থাকলেও সেখানে কোনো শিশুকেই সেবা দেওয়া হচ্ছে না।
প্রীতিলতা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ফারহানা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্প উন্নয়ন বাজেটের আওতায় ছিল। জনবলও প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ করা হয়েছে। ২০২০ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এখন রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য বিষয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। সেটি গ্রহণ করতে একটু সময় লাগার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, আটটি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল পরিচালনা করছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। এগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর ও রাজশাহীতে অবস্থিত।
চুরির ঘটনায় লুকোচুরি
প্রীতিলতা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের অবস্থান কালীগঞ্জ থানা এলাকার মধ্যে। কিন্তু চুরির বিষয়টি জানেন না কালীগঞ্জ থানার ওসি আনিসুর রহমান। সোমবার তিনি বলেন, চুরির বিষয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীনও দাবি করেন, বৈদ্যুতিক তার চুরির ঘটনা তিনি জানেন না।
হোস্টেল সুপার ফারহানা ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, অধিদপ্তরকে লিখিত আকারে চুরির ঘটনাটি জানানো হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক তাঁকে বলেছেন, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।
প্রকল্প পরিচালক ফারহানা আখতারও জানিয়েছেন, চুরির ঘটনায় কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, বিষয়টি (চুরি) গুরুত্ব দিয়েই দেখা হচ্ছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।