‘নাদুসনুদুস’ মানেই সুস্বাস্থ্য নয়

পুষ্টিবিদদের মতে, অনেক মা–বাবা সন্তান ‘নাদুসনুদুস’ হলে মনে করেন সন্তান সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। নাদুসনুদুস বা স্থূলকায় হওয়া মানে সুস্বাস্থ্য নয়।

শিশুটির বয়স ছয় বছর হলেও একই বয়সের অন্য শিশুদের তুলনায় তাকে শারীরিকভাবে বেশ বড় দেখায়। বয়স অনুযায়ী ওজনও বেশি। শিশুটির মা বলছিলেন, জন্মের সময়ই বেশ ‘নাদুসনুদুস’ ছিল তাঁর মেয়ে। এক বছর বয়স থেকে মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি ঝোঁক বাড়তে শুরু করে। এখন প্রায় প্রতিদিনই দোকান থেকে চকলেট, বিস্কুট, কেক এবং কোমল পানীয় কিনে খাওয়াতে হয়।

শিশুর মা জানান, তাঁদের সন্তানের মাথা ও শরীর অতিরিক্ত ঘামতে থাকে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে পা ব্যথা করে। শিশু চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে দ্রুত সন্তানের ওজন কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

অতি ওজনের শিশুকে নানান রকম কষ্টে ভুগতে হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে রক্তে চর্বি জমে হৃদ্‌রোগের সমস্যা হতে পারে।
অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, বারডেমের মা ও শিশু হাসপাতাল 

চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে, জন্মের সময় একটি শিশুর ওজন আড়াই থেকে সাড়ে চার, কখনো পাঁচ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। পরে বয়সের সঙ্গে কেউ কেউ স্থূলকায় হয়ে যায়। মুটিয়ে যাওয়া শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই আক্রান্ত হয় নানাবিধ জটিল রোগে।

অক্সফোর্ড একাডেমিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে স্থূলতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিশুদের মধ্যে ১ থেকে ২৩ শতাংশ এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ১ দশমিক ৭ থেকে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩২ বছরে বিশ্বব্যাপী বয়ঃসন্ধিকালীন স্থূলতা চার গুণ বেড়েছে।

কখন বুঝবেন শিশু মুটিয়ে গেছে

উচ্চতা ও ওজনের ওপর দেহের বিএমআই (বডি ম্যাস ইনডেক্স) বা স্থূলতা পরিমাপ করা হয়। বিএমআইয়ের একক কেজি/বর্গমিটার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) দেওয়া স্থূলতার সংজ্ঞা হচ্ছে, শরীরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চর্বি জমে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হওয়া। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে তা বিএমআইয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হলেও শিশুদের স্থূলতা নির্ধারণের তরিকা কিছুটা ভিন্ন। শিশু স্থূল কি না, তা যাচাই করা হয় শিশুটিকে একই বয়স ও লিঙ্গের অন্য শিশুদের সঙ্গে তুলনা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) তাদের ‘২০০০ বৃদ্ধি চার্ট’ অনুসারে, একই বয়সী ও একই লিঙ্গের শিশুর তুলনায় কোনো শিশুর বিএমআই ৯৫ শতাংশ বা এর বেশি হলে সেই শিশু স্থূলকায়।

পুষ্টিবিদদের মতে, অনেক মা–বাবা সন্তান ‘নাদুসনুদুস’ হলে মনে করেন সন্তান সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। নাদুসনুদুস বা স্থূলকায় হওয়া মানে সুস্বাস্থ্য নয়। অনেক অভিভাবক সন্তান কী খাচ্ছে, কতটা খাচ্ছে, সেটি যাচাই-বাছাই না করে সন্তান যা খেতে চাইছে, তা আরও বেশি করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। স্বাদ বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এটা করতে গিয়ে অনেক সময় পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যের পুষ্টিগুণ নষ্ট করে ফেলেন অতিরিক্ত উপকরণ যোগ করে। যেমন দুধের স্বাদ বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত চিনি ও স্বাদযুক্ত গুঁড়া মেশান। অনেক সময় চিনিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয়, চকলেট, ক্যান্ডি, লবণাক্ত চিপস ছাড়াও অস্বাস্থ্যকর ফাস্ট ফুড খেতে দেন। এসব খেয়ে শিশু মোটা হয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বড় হয়।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২-এ দেখা যাচ্ছে, ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু কোমল পানীয়, অতিরিক্ত লবণ ও চিনিসমৃদ্ধ প্রক্রিয়াজাত খাবার খাচ্ছে।

বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিশেষজ্ঞ শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, সন্তানের ওজন বেশি হলে অনেক অভিভাবক এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন যে সন্তানের স্বাস্থ্য ভালো। এদিকে শিশুর অতিরিক্ত ওজন হচ্ছে, তার স্বাস্থ্যের ওপর আসন্ন বিপৎসংকেত। যতই দিন যাচ্ছে, শিশুদের শিশুসুলভতা কমে আসছে। তারা খেলে না, সাঁতার কাটে না, নিয়মিত ব্যায়ামও করছে না। তাই তারা যা–ই খাচ্ছে, তা শরীরে জমে চবি৴তে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলাফল, শিশুরা মুটিয়ে যাচ্ছে।

স্থূলকায় হওয়ার ঝুঁকি

বারডেমের মা ও শিশু হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, অতি ওজনের শিশুকে নানান রকম কষ্টে ভুগতে হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে রক্তে চর্বি জমে হৃদ্‌রোগের সমস্যা হতে পারে। ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত ঘাম, ঘাড় কালো হওয়া এবং স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। পরে এই শিশুরা ডায়াবেটিসের মতো চিরব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছানোর আগে তাদের যৌনতা হ্রাস পায়। মেয়েশিশুরা বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনজনিত রোগ পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে (পিসিওএস) আক্রান্ত হয়। তবে শুধু শারীরিকভাবেই নয়, অনেক ক্ষেত্রে মানসিকভাবেও কটাক্ষের শিকার হতে হয় মুটিয়ে যাওয়া শিশুদের। এসব থেকে সন্তানকে বাঁচাতে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া ছাড়া গতি নেই।

শিশুর স্থূলকায় হয়ে যাওয়ার পেছনে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, খেলার জায়গা না থাকা, স্কুলগুলো বা আবাসনের আশপাশে স্বাভাবিক হাঁটাচলা না করা, কম্পিউটার ও মুঠোফোন আসক্তি, রাত জাগার অভ্যাসকেও দায়ী করেছেন অভিভাবক ও শিশুবিশেষজ্ঞরা।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, শিশুর জন্য নিদি৴ষ্ট খেলার জায়গা, হাঁটার জায়গা, পরিকল্পিত দোকানপাট থাকবে—এমন সুপরিকল্পিত আবাসন গড়ে তোলা দরকার। এখন পয৴ন্ত শুধু ঢাকায় পরিকল্পিত আবাসন আছে মাত্র ১১ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ। এটা আরও বাড়াতে হবে।