স্থানীয় সরকারব্যবস্থা
হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণে দুর্বল স্থানীয় সরকার
জনপ্রতিনিধিদের শাসন নেই স্থানীয় সরকারে। জনপ্রতিনিধিরা কার্যত সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে শাসিত।
উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ ও আমলাদের নিয়ন্ত্রণ। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অনেক ক্ষেত্রেই আমলাদের মাধ্যমে শাসিত হচ্ছেন। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার–সংক্রান্ত বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে অস্পষ্টতা ও অসংগতি রয়েছে, যা স্থানীয় সরকার–কাঠামোকে দুর্বল করে রাখছে।
এসব বিষয় উঠে এসেছে ‘স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে চ্যালেঞ্জ ও নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশিষ্টজনদের আলোচনায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন–বিশেষজ্ঞরা। আজ শনিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এই সেমিনারের আয়োজন করে নির্বাচনবিষয়ক রিপোর্টারদের সংগঠন রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি)।
সেমিনারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংসদ সদস্যদের কাজ তো প্রশাসনিক না। এখন উপজেলা পরিষদ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সব কটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে একই অবস্থা। সংসদ সদস্যরা সব দেখভাল করছেন। আমলারা সংসদ সদস্যদের সঙ্গেই যোগাযোগ করেন। দেশে এখন যে রাজনৈতিক আবহ, তাতে সংবিধানে কী লেখা আছে তা কোনো বিষয়ই না বলে মনে করেন তিনি।
দেশে এখন যে রাজনৈতিক আবহ, তাতে সংবিধানে কী লেখা আছে তা কোনো বিষয়ই না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, আমলাতন্ত্রের দরকার আছে; কিন্তু তারা যেন শাসক হয়ে না যায়। স্থানীয় সরকারে ভালো নির্বাচন করার বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু দলীয় প্রতীককে ‘আসামি’ করলে হবে না, রাজনৈতিক শিষ্টাচারেও সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদে প্রশাসনিক নেতৃত্ব নিয়ে জটিলতা রয়েছে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আইন এবং বিধিবিধানেও অস্পষ্টতা এবং অসংগতি রয়েছে, যা উপজেলাকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী।
সংসদ সদস্যদের ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও হুইপ স্থানীয় উন্নয়নকাজে যুক্ত হতে পারবেন না—এ বিষয়ে আদালতের রায় রয়েছে। স্থানীয় সরকার–ব্যবস্থা দুর্বল থাকার কারণ দুটি। একটি হচ্ছে সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ, দ্বিতীয়টি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ। এসব প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধিদের শাসন নেই, জনপ্রতিনিধিরা কার্যত সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে শাসিত।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর ভিন্নমত
নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার–বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি উপজেলা পরিষদে সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ নিয়ে খুব বেশি সমস্যা দেখছেন না।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার ও তৃণমূলের মধ্যে সংযোগের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা রয়েছে। সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদে উপস্থিত হয়ে কথা বলতেই পারেন। সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই। দেশের শাসনব্যবস্থা পিরামিডের মতো, সংসদ সদস্যদের নিচে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হবে।
সংসদ সদস্যদের ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, এ কথাটা কোথা থেকে এল তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প করেছে। এর আওতায় প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ৫ বছরে ২৫ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হবে। সেখানে সংসদ সদস্যরা মতামত দিতে পারবেন; কিন্তু হাত দিয়ে টাকা স্পর্শ করার সুযোগ পাবেন না সংসদ সদস্যরা।
‘প্রকল্প সংস্কৃতি’
সেমিনারে স্থানীয় সরকার–বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকারের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও আগ্রহ কম। তাঁদের আগ্রহ প্রকল্প পাওয়ার দিকে। এই ‘প্রজেক্ট কালচার’ (প্রকল্প সংস্কৃতি) থেকে বের হতে হবে। তাঁর মতে, রাজনীতিতে মূল সমস্যা নেতৃত্বের বিকাশে। দুর্বৃত্তরা দলগুলোর কর্তৃত্ব দখল করে নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, বর্তমানে পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (জেলা ও উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচন পাঁচবারে হয়। ফলে সারা বছরই নির্বাচন চলতে থাকে। ভারতে স্থানীয় সরকারের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একই দিনে হয়। এতে সময় ও ব্যয় সাশ্রয় হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ও ভালো হয়। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রতিটি স্থানীয় সরকারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন যে আইন রয়েছে, সেগুলো একীভূত করে একটি একক আইন (মাদার ল) করতে হবে।
নির্বাচনে আস্থা থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের মুখ্য পরিচালক আবদুল আলীম। তিনি বলেন, ভোট উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক হতে হয়, এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কী সেভাবে হয়েছে? এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা যায় না।
আয়োজক সংগঠন আরএফইডির সভাপতি একরামুল হকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবীরের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ও ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের বার্তাপ্রধান আশীষ সৈকত প্রমুখ।
আমলাদের নিয়ন্ত্রণ
প্রশাসন দলীয় আনুকূল্য পাওয়ার জন্য কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত হয়ে যায় বলে সেমিনারে উল্লেখ করেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি মো. বেলায়েত হোসেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারলে নির্বাচনে অবশ্যই দলীয় ও ব্যক্তির প্রভাব কমবে।
দোহার উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, উপজেলা পরিষদের বিদ্যমান আইন এখন পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি। উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করতে হলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমেই এই পরিষদ চালাতে হবে। এখন সেটি হচ্ছে না।
আমলারা উপজেলা পরিষদের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন বলে উল্লেখ করেন উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক রাশেদা আকতার।