মোগলবিরোধী মুসা খানের মসজিদ, পাশে বীর যোদ্ধার সমাধি

ঢাকার অন্যতম প্রাচীন ‘মুসা খান মসজিদ’ অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। অনেকের মতে, মসজিদটি মুসা খানের দৌহিত্র দেওয়ান মনোয়ার খান নির্মাণ করেছেন। মুসা খান বাংলার স্বাধীন শাসক বারো ভূঁইয়ার প্রধান ঈসা খানের পুত্র। এই মসজিদ নিয়ে ২০২৩ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আবার প্রকাশ করা হলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় ‘মুসা খান মসজিদ’। স্বাধীন শাসক বারো ভূঁইয়ার প্রধান মসনদ-ই আলা ঈসা খানের পুত্র মুসা খানের নামে এই নামকরণছবি : তানভীর আহাম্মেদ

এলাকাটির নাম আগে ছিল ‘বাগ-ই-মুসা খাঁ’। স্থানটি অনেকেরই কমবেশি দেখা, জানা। তবে এই নামে সাধারণত কেউ একে চেনেন না। এটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল এলাকা। বাংলার স্বাধীন শাসক বারো ভূঁইয়ার প্রধান মসনদ-ই আলা ঈসা খানের পুত্র মুসা খান এ এলাকায় একটি মনোরম বাগিচা তৈরি করেছিলেন।

হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ‘আসুদগান-ই ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছেন, মুসা খানের নামানুসারেই এলাকাটির ওই নামকরণ করা হয়েছিল। দেওয়ান মুসা খানের বাগানটি নেই। তবে তাঁর কবর আছে এখানেই। আর তাঁর স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট ‘মুসা খান মসজিদ’।

মুসা খান মসজিদের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকজুড়ে আছে অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব বিভাগ, শহীদুল্লাহ হলসহ বিভিন্ন বিভাগ ও প্রশাসনিক কার্যালয়। সামনে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে নাজিমুদ্দিন (একদা এর নাম ছিল মুসা খান সড়ক) রোডের দুই পাশ দিয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবহনের দোতলা বাসগুলো। উপরন্তু এই দিকটিতে ফুটপাতের পর থেকে লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। সামনে দিয়ে যাতায়াতও করা যায় না। মসজিদটি সহজে চোখেও পড়ে না।

মুসা খানের মসজিদের কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। সে কারণে সুনির্দিষ্ট করে এর নির্মাণকাল জানা যায় না। মসজিদটির নাম মুসা খান মসজিদ হলেও তিনি এর নির্মাতা নন বলেই অধিকাংশ ঐতিহাসিকের অনুমান।

উপেক্ষায়–অযত্নে মুসা খানের মসজিদ এখন মলিন বিবর্ণ। বহু বছর আগে এর বুরুজ আর সরু মিনারগুলো ছাই রং ও দেয়ালে ফিকে হলুদ রং করা হয়েছিল। তা রোদে–বৃষ্টিতে বিবর্ণ। ময়লা, ছত্রাক জন্মেছে স্থানে স্থানে। মসজিদের ভেতরের দৃশ্যেও কোনো ভিন্নতা নেই। হয়তো একই সময় ভেতরের দেয়ালে সাদা রং করা হয়েছিল। তা এখন কালচে হয়ে আছে। গম্বুজের ভেতরে, মিনারে নিচের দিকের কলসগুলো থেকে ঝরে পড়ছে আস্তরণ। মেঝেতে নামাজিদের জন্য যে মাদুর পাতা আছে, তার অবস্থাও তথৈবচ।

মসজিদে নামাজ হয় নিয়মিতই। তবে আজান দেওয়ার মুয়াজ্জিন নেই। রক্ষণাবেক্ষণের খাদেম নেই। শনিবার দুপুরে মসজিদে গিয়ে দেখা গেল এক তরুণ কোরআন তিলাওয়াতে মগ্ন। খানিক পরেই জোহরের ওয়াক্ত হলে তিনিই উঠে গিয়ে মাইকের সুইচ চালু করে আজান দিলেন।

মুসা খান মসজিদের ভেতরের একাংশ
ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

নামাজ শেষে কথা হলো মুসা খান মসজিদের ইমাম হাফেজ মামুনুর রশীদের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০০৪ সাল থেকে এই মসজিদের ইমামতি করছেন। মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম ও ঝাড়ুদার—এই চারটি পদ আছে। তবে নিযুক্ত আছেন তিনি একাই। ওয়াক্ত হলে অনেক সময় তিনি নিজেই আজান দেন, আবার অনেক সময় আশপাশের লোকেরা আজান দেন। মসজিদের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজেও তাঁকেই হাত লাগাতে হয়। আল্লাহর ঘর, অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় তো ফেলে রাখা যায় না। তিনি জানালেন, এই মসজিদের অধিকাংশ মুসল্লিই চানখাঁরপুল, নাজিমুদ্দিন রোড, আগা সাদেক রোডসহ আশপাশের পুরান ঢাকার বিভিন্ন মহল্লার বাসিন্দা। ছাত্ররা সাধারণত তাঁদের হলের মসজিদেই নামাজ আদায় করেন।

মসজিদটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটি পরিচালনা করছে। তবে পুরান ঢাকার মুসল্লিরা এখনো এখানে নামাজ আদায় করেন। ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি তারাবিহর জামাতও হয় প্রতি রমজান মাসে।

ইমাম মামুনুর রশীদ জানান, মসজিদটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রত্নসম্পদ। অবশ্য স্বাধীনতার আগে মুসা খানের মসজিদ পরিচালিত হতো পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সহায়তায়। মসজিদ পরিচালনা কমিটি করে তারা এর ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতেন। পরে মসজিদটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটি পরিচালনা করছে। তবে পুরান ঢাকার মুসল্লিরা এখনো এখানে নামাজ আদায় করেন। ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি তারাবিহর জামাতও হয় প্রতি রমজান মাসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকের পক্ষ থেকে প্রতি সন্ধ্যায় প্রায় ৫০ জনের মতো রোজাদারের ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। এবারও তারাবিহ-ইফতার চালু রয়েছে।

স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য

একটি উঁচু ভিত্তির ওপর মুসা খান মসজিদটি নির্মিত। ভূমি থেকে এর উচ্চতা ৩ দশমিক শূন্য ৫ মিটার। দক্ষিণ–পশ্চিম কোণে রয়েছে সিঁড়ি, ১২টি ধাপ বেয়ে উঠতে হয় মসজিদে। সামনে বারান্দার মতো খোলা চত্বর। মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি মসজিদে তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি বড়। গম্বুজগুলোর চূড়া এবং শীর্ষ পদ্ম ও কলসে অলংকৃত ছিল। এ ছাড়া চারপাশে রয়েছে চারটি অষ্টভুজাকার বুরুজ এবং পাশ দিয়ে মোট ১২টি সরু মিনার। দরজা মোট ৫টি।

মুসা খানের মসজিদের কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। সে কারণে সুনির্দিষ্ট করে এর নির্মাণকাল জানা যায় না
ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

উত্তর-দক্ষিণে একটি করে এবং পূর্ব দিকে তিনটি। এর মাঝেরটি আকারে বড়। প্রতিটি দরজাই অর্ধ গম্বুজাকৃতির খিলানের মতো। পশ্চিম দিকের দেয়ালে তিনটি মেহরাব। এগুলো পূর্ব দিকের দেয়ালের দরজার বরাবর। ভেতরে কার্নিশে বদ্ধ মিনার নকশা এবং দেয়ালে আছে বর্গাকৃতির নকশা। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য ১৭ দশমিক ৬৪ মিটার এবং প্রস্থ ১৪ দশমিক শূন্য ২ মিটার। এর পূর্ব ও পশ্চিম দিকের দেয়াল ১ দশমিক ৮১ মিটার এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দেয়াল ১ দশমিক ২ মিটার পুরু। মসজিদের ভেতরে তিনটি কাতার এবং বাইরে চারটি মোট সাতটি কাতার রয়েছে। প্রতি কাতারে প্রায় ২৫ জন করে মোট ১৭৫ থেকে ১৮০ জনের মতো মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন।

মুসা খান মসজিদ একটি উঁচু ভিত্তির ওপর নির্মিত। ভূমি থেকে এর উচ্চতা ৩ দশমিক শূন্য ৫ মিটার। দক্ষিণ–পশ্চিম কোণে রয়েছে সিঁড়ি, ১২টি ধাপ বেয়ে উঠতে হয় মসজিদে। মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এ মসজিদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ।

মসজিদের নিচের তলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি কক্ষ। পূর্ব দিকে তিনটি খিলান আকৃতির দরজা। এই কক্ষগুলো এখন আবর্জনা আর দেয়ালের আশপাশ জংলা গাছপালায় ভরা। ভেতরে ঢোকা যায় না।

বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, মুসা খান মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিমে তিনটি করে ছয়টি কক্ষ রয়েছে। দেয়াল অলংকৃত এবং প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে বই রাখার তাক ছিল। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এখানে বসবাস করতেন।

মুসা খানের মসজিদের কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। সে কারণে সুনির্দিষ্ট করে এর নির্মাণকাল জানা যায় না। মসজিদটির নাম মুসা খান মসজিদ হলেও তিনি এর নির্মাতা নন বলেই অধিকাংশ ঐতিহাসিকের অনুমান।

হাকিম হাবিবুর রহমান মসজিদটি মুসা খানের নির্মিত বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানী, আ ক ম যাকারিয়া ও মুনতাসীর মামুন মনে করেন, এটি শায়েস্তা খানের আমলে নির্মিত হয়েছিল। উত্তর দিকে অদূরেই হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদের (বর্তমানে জাতীয় তিন নেতার মাজারের পেছনে) সঙ্গে মুসা খান মসজিদের স্থাপত্য ও নির্মাণকৌশলের অনেক মিল রয়েছে। এ কারণে তাঁরা মনে করেন, মসজিদটি মুসা খানের দৌহিত্র দেওয়ান মনোয়ার খান নির্মাণ করেছিলেন এবং পিতামহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করেছিলেন।

মুসা খানের অন্তিমশয্যা

১৫৯৯ সালে ভাটি অঞ্চলের অধিপতি স্বাধীন বারো ভূঁইয়ার প্রধান মসনদ-ই-আলা ঈসা খানের মৃত্যু পর তাঁর পুত্র মুসা খান মসনদে আসীন হন। তিনিও পিতার মতোই সাহসী বীর যোদ্ধা ছিলেন।

বাবা ঈসা খানের মতো মোগলদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধসংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন মুসা খান। এই মসজিদের পাশেই শেষশয্যায় শায়িত মুসা খান
ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, মুসা খানের রাজ্য ছিল বর্তমানের বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লার অর্ধাংশ বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলাজুড়ে। মোগলদের বিরুদ্ধে মুসা খান পিতা ঈসা খানের মতোই প্রবল প্রতিরোধসংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সুবাদার ইসলাম খানের সেনাপতি মির্জা নাথান ও নৌ সেনাপতি ইহতিমাম খানের সঙ্গে সংগ্রাম করে পরাভূত হন। রাজধানী সোনারগাঁর পতন হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি মোগল সুবাদারের অনুগ্রহ লাভ করে জমিদারি ফিরে পেয়েছিলেন। শেষ জীবনে তিনি দীর্ঘদিন জটিল রোগে ভুগে ১৬২৩ সালের এপ্রিল মাসেই ইন্তেকাল করেন। বাগ-ই মুসাতে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। মুসা খানের কবর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের পাশে। শুধু এক পলাশগাছ তার ডালপালা মেলে ছায়া দিয়ে রেখেছে সাহসী বীর যোদ্ধা মুসা খানের অন্তিমশয্যার ওপরে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন