অনেকের মধ্যে এই ধারণা প্রকট যে স্ক্যাবিস শুধু নোংরা পরিবেশে থাকা মানুষদেরই হয়। এটি একটি অত্যন্ত ভুল ধারণা। যাঁরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলেন না, তাঁদের মধ্যে এই রোগ দেখা যায়। তবে একজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষও আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের কারণে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই শুধু পরিচ্ছন্নতা এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে পারে না।
প্রথম আলো ডটকম ও এসকেএফ ডার্মাটোলজির যৌথ উদ্যোগে ‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় ক্লিয়ার স্কিন সেন্টার ধানমন্ডির পরিচালক এবং এভারকেয়ার হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. হাসিবুর রহমান এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার সুরাইয়া আহমেদ।
এখনো স্ক্যাবিস ও দাদ নিয়ে রয়েছে অবহেলা, এর চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও সচেতনতার অভাব। তাই আলোচনার এ পর্বে স্ক্যাবিস ও দাদ নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. হাসিবুর রহমান। গত শনিবার তা সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
আলোচনার শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান, বর্তমানে প্রায় সারা দেশে স্ক্যাবিস ও দাদের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, এর কারণ কী?
উত্তরে অধ্যাপক ডা. হাসিবুর রহমান বলেন, এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো সচেতনতার অভাব, সঠিক চিকিৎসার ঘাটতি এবং রোগনির্ণয়ে সমস্যা। এ ছাড়া মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা পরিবর্তিত হওয়ায় এবং স্টেরয়েড ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের কারণেও রোগটি সহজে ছড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বর্তমানে কিছু ওষুধের কার্যকারিতা কমে গেছে এবং অনেক সময় রোগীরা সঠিক মাত্রায় ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওষুধ গ্রহণ না করেই মাঝপথে বন্ধ করে দেন। এটিও এই রোগের অনেক বড় একটি কারণ।
স্ক্যাবিস ও দাদ দুটোই কি ছোঁয়াচে রোগ? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. হাসিবুর রহমান জানান, স্ক্যাবিস ও দাদ দুটোই ছোঁয়াচে রোগ। তবে এটি নির্ভর করে ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধক্ষমতার ওপর। যাঁরা অপুষ্টিতে ভোগেন, যাঁদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড–জাতীয় ওষুধ খেয়েছেন, তাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম হওয়ায় রোগটি দ্রুত ছড়ায়। এ ছাড়া একটি পরিবারে একজন এসব রোগে আক্রান্ত হলে অন্য সবার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি রোগীদের কী কী বিশেষ নিয়ম মেনে চলা উচিত? জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. হাসিবুর রহমান বলেন, চিকিৎসার পাশাপাশি বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলা খুব জরুরি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া স্টেরয়েড–জাতীয় কোনো ওষুধ ব্যবহার না করা। স্টেরয়েড সাময়িকভাবে রোগ কমিয়ে দিলেও পরে তা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে আসে, যা রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা কঠিন করে তোলে। এ ছাড়া অবশ্যই একজন সার্টিফায়েড চিকিৎসকের কাছে সঠিক রোগনির্ণয় করতে হবে। কোর্স শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওষুধ গ্রহণ বন্ধ করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে ডা. হাসিবুর রহমান আরও বলেন, যদি কারও ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। একই সঙ্গে পরিবারের সব সদস্যের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবহৃত কাপড়চোপড়, তোয়ালে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে বা ইস্তিরি করে ব্যবহার করতে হবে।
কোভিডের সঙ্গে এই চর্মরোগগুলোর কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে ডা. হাসিবুর রহমান বলেন, রোগীরা প্রায়ই এই প্রশ্ন করেন এবং তাঁদের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত যে কোভিডের পর থেকে এই রোগগুলো বেশি হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা এটি প্রমাণিত নয়। এটি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।
ডায়াবেটিস এবং খাবারের সঙ্গে এই রোগগুলোর সম্পর্ক বিষয়ে ডা. হাসিবুর রহমান বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। ফলে এই রোগগুলো সহজে ভালো হতে চায় না। তাই চিকিৎসার আগে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। খাবারের সঙ্গে এই রোগগুলোর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু যদি কারও নির্দিষ্ট কোনো খাবারে অ্যালার্জি না থাকে, তাহলে তিনি সেই খাবারটি কিছু সময়ের জন্য এড়িয়ে চলতে পারেন।
স্ক্যাবিসের চুলকানি রাতের বেলায় কেন বেড়ে যায়? জানতে চাইলে ডা. হাসিবুর রহমান বলেন, স্ক্যাবিস মূলত সারকোপটিস নামক একটি পরজীবীর সংক্রমণে হয়ে থাকে। এই পরজীবী দিনের বেলায় নিষ্ক্রিয় থাকে, কিন্তু রাতে যখন শরীর শান্ত থাকে, তখন এরা ত্বকের নিচে চলাচল শুরু করে। এই চলাচল ত্বকে একধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ফলে রাতের বেলায় চুলকানি প্রচণ্ড বেড়ে যায়।
স্ক্যাবিসের মলম ব্যবহারের সঠিক নিয়ম নিয়ে অধ্যাপক ডা. হাসিবুর রহমান বলেন, স্ক্যাবিসের মলম মূলত সারা শরীরে অর্থাৎ মুখ বাদে মাথা থেকে পা পর্যন্ত লাগাতে হয়। শুধু আক্রান্ত স্থানে লাগালে জীবাণু অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। মলমটি নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত শরীরে রেখে পরে ধুয়ে ফেলতে হবে।
উপস্থাপক জানতে চান, দাদ কেন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে? উত্তরে ডা. হাসিবুর রহমান জানান, দাদ দ্রুত ছড়ানোর প্রধান কারণ হলো স্টেরয়েডযুক্ত ওষুধ বা মলমের ভুল ব্যবহার। যখন স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়, তখন ছত্রাক সাময়িকভাবে দমন হয়। কিন্তু স্টেরয়েড ব্যবহার বন্ধ করে দিলে এটি ভয়ংকর রূপে এবং দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। চুলকানি প্রতিরোধ করতে না পারাও দাদ দ্রুত ছড়ানোর একটি কারণ।
এ প্রসঙ্গে ডা. হাসিবুর রহমান আরও বলেন, যাঁরা দীর্ঘ সময় জুতা ও মোজা পরে থাকেন, বিশেষ করে যাঁদের পায়ের আঙুলের ফাঁকে জায়গা কম, তাঁদের পায়ে দাদ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
সর্বোপরি আলোচনায় উঠে আসে, স্ক্যাবিস ও দাদ দুটোই চর্মরোগ হলেও এগুলোর প্রকোপ এখন এতটাই বেড়েছে যে সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস আলাদা রাখা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করলেই এই রোগগুলো থেকে দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব। মহামারির মতো পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে একক প্রচেষ্টার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সবার সম্মিলিত উদ্যোগও এখন সময়ের দাবি।