সোনার জিলাপিতে আসলে কী ছিল, খাওয়া ক্ষতিকর না উপকারী

সম্প্রতি রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বিক্রি হয় সোনার প্রলেপ দেওয়া বিশেষ ধরনের এ জিলাপি
ফাইল ছবি

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল হইচই ফেলে দিয়েছিল সোনায় মোড়ানো জিলাপি বিক্রি করে। ৫ এপ্রিল ২০২৩ রমজানের মধ্যে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ‘প্রতি কেজি জিলাপির দাম ২০ হাজার টাকা! না, ভুল শোনেননি। বিশেষ এই জিলাপি ২৪ ক্যারেটের সোনা দিয়ে মোড়ানো। সে জন্যই এত দাম। রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বিক্রি হচ্ছে বিশেষ ধরনের এ সোনার প্রলেপ দেওয়া জিলাপি।

‌‘রমজান উপলক্ষে এই জিলাপি তৈরি করেছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল কর্তৃপক্ষ। সাধারণ গ্রাহকদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আজ বুধবার থেকে এটি বিক্রি শুরু হয়েছে। প্রতি কেজি জিলাপিতে ২৪ ক্যারেটের খাবার উপযোগী সোনার ২০ থেকে ২২টি লিফ বা পাতলা পাত থাকবে। একজন গ্রাহক ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম জিলাপি কিনতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে দাম পড়বে পাঁচ হাজার টাকা।’ (ঢাকায় সোনায় মোড়ানো যে জিলাপির কেজি ২০ হাজার টাকা, প্রথম আলো ডটকম, ৫ এপ্রিল ২০২৩)

১০ এপ্রিল প্রথম আলো ডটকমে আরেকটা খবরে জানানো হয়, ‘গত সপ্তাহে এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে সোনায় মোড়ানো জিলাপি বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ঢাকা। গত মঙ্গলবার দেওয়া ওই পোস্টে বলা হয়েছিল, বিশেষ জিলাপির প্রতি কেজির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। এর মাত্র সাত দিনের মাথায় আরেকটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে হোটেলটির কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, তারা আর জিলাপির অর্ডার নিচ্ছে না।

‌‘আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার ফেসবুক পেজে জানানো হয়, “গোল্ড জিলাপি সোল্ড আউট”। অর্থাৎ, সোনার আবরণে ঢাকা জিলাপি বিক্রি শেষ হয়েছে।’ (সোনায় মোড়ানো ২০ হাজার টাকা কেজির জিলাপির অর্ডার নেওয়া বন্ধ)

সোনায় মোড়ানো জিলাপিতে আসলে কী থাকে? এ প্রশ্ন করা হয়েছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বিক্রয় এবং বিপণন বিভাগের পরিচালক রেজওয়ান মারুফকে। তিনি জানান, এই জিলাপিতে ২৪ ক্যারেট এডিবল গোল্ড লিফ বা খাওয়ার উপযোগী সোনার পাত থাকে। এই গোল্ড লিফ ঢাকায় হোটেলটির নিয়মিত সরবরাহকারীরাই জোগান দিয়েছেন বলে জানান হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার মহাব্যবস্থাপক অশ্বিনী নায়ার। মোট কত পরিমাণে গোল্ড লিফ বা সোনার পাত ব্যবহার করা হয়েছে এবং মোট কত কেজি সোনা মোড়ানো জিলাপি বিক্রি করা হয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তর কর্তৃপক্ষ দিতে চাননি। অশ্বিনী রায় বলেন, এই জিলাপি বানানোর উদ্দেশ্য ছিল হোটেলের রেস্টুরেন্টের এবং খাবারের ইতিবাচক প্রচার করা। তাতে তাঁরা সফল হয়েছেন। এ জন্য পরে আর এই জিলাপি বানানোর সোনার পাত সংগ্রহের জন্য তাঁরা আর চেষ্টা করেননি।

‘রাফসান দ্য ছোটভাই’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে একটা ভিডিও দেখানো হয়েছে. যাতে ইন্টারকন্টিনেন্টালের সোনার জিলাপি কেনা হয়। পরে সেই জিলাপি একটা জুয়েলারি দোকানে গিয়ে কম্পিউটারে পরীক্ষা করা হয়। এই ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, এই জিলিপির পাতগুলো সত্যিকারের সোনা বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে ইউটিউব ভিডিওর দাবি, এগুলো ১৮ ক্যারেটের।

খাবার উপযোগী সোনা কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো? নাকি ক্ষতিকর? টাইমস অব ইন্ডিয়া ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০-এর এক প্রতিবেদনে বলছে, খাওয়ার সোনা শুধু সৌন্দর্য বাড়ায় না, এটা শরীরের জন্যও উপকারী। ইট দিস ডট কম নামের একটা ওয়েবসাইট সোনা খাওয়ার ফলে বাতের ব্যথায় উপকার হয় বলে জানানো হয়েছে। বারনাবাস ডট কম নামের একটা সাইটে সোনার পাত মোড়ানো খাবার নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা করা হয়েছে। তাতে জানানো হয়, গয়নার সোনা আর খাওয়ার সোনা আলাদা। খাওয়ার সোনার কোনো অপকারিতা নেই। কারণ, সোনা অ্যাসিডে গলে না, এটা হজম হবে না, শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে। কাজেই এর কোনো উপকারিতাও নেই, আবার এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকারকও নয়। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যনিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ এফডিএ সোনার পাত খাওয়ার উপযোগী, নাকি ক্ষতিকর—এ নিয়ে কিছু বলেনি। ইউরোপের খাদ্যনিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ খাওয়ার উপযোগী সোনা নিয়ে একটা বিশেষ নিয়ম চালু করেছে, যার নাম ই-১৭৫। এতে কত ওজনের মানবদেহে কতটুকুন সোনা খাওয়া নিরাপদ, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই বিধি ১৯৭৫ সালে প্রথমে করা হয়, ২০১৬ সালে তা পুনর্নির্ধারণ করা হয়!

আরও পড়ুন

সোনার জিলাপি নিয়ে বাংলাদেশে হইচই হলেও কেক, পেস্ট্রি, আইসক্রিম, চকলেটে সোনা কিংবা রুপার তবক দেওয়া বিভিন্ন দেশে একটা প্রচলিত ব্যাপার। প্রধানত সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যই এই সোনার পাতগুলো দেওয়া হয়। যেমন পান বা সন্দেশ বা লাড্ডুতে রুপালি মোড়ক দেওয়া হয়। তবক কথাটার আভিধানিক অর্থই রুপা বা সোনার পাত।

এখন এই সোনার পাতের দাম কত? আমেরিকায় অনলাইন শপে ৪০০ মিলিগ্রামের দাম বলা হচ্ছে ৬০ ডলার। প্রায় ৭ হাজার টাকা। বাংলাদেশে এর দাম কত পড়বে, ধারণা করা মুশকিল।

তবে এই সোনার পাতগুলো নানাভাবে প্রক্রিয়াজাত করে একেবারে মিহি করে ফেলা হয়। আর এতে কোনো ভেজাল থাকতে পারবে না। তাহলেই এই সোনার পাত খাওয়ার উপযোগী হয়।

খাওয়ার সোনা একেবারে খাঁটি সোনা হলেও অলংকার বানানোর সোনা থেকে এটা আলাদা। গয়না বানানোর সোনা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ঢাকায় ২০ হাজার টাকা কেজি জিলাপির উচ্চ চাহিদা নিয়ে নানা কথা হয়েছে। এর আগে, ‘গত বছরের জুলাই মাসে দেশে সোনায় মোড়ানো আইসক্রিম বিক্রির খবর বেশ সাড়া ফেলেছিল। রাজধানীর বনানীর পাঁচ তারকা হোটেল সারিনা তাদের ১৯তম বর্ষপূর্তিতে বিশেষ ওই আইসক্রিম বিক্রি করে। ২৪ ক্যারেটের খাওয়ার যোগ্য সোনা দিয়ে তৈরি ওই আইসক্রিমের দাম ছিল ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা।’

এটা যেমন একশ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ধারণা দেয়, তেমনি দেশে বৈষম্য বাড়ারও এটা একটা সূচক বলে অনেকে মনে করেন।

আরও পড়ুন