উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি, ১২ দিন ধরে অচল বিশ্ববিদ্যালয়

উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ছেলেমেয়েদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদের অপসারণের দাবিতে প্রতীকী অবস্থান কর্মসূচি। গত রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেফমুবিপ্রবি) উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ছেলেসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়োগ ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে নেমেছেন শিক্ষকেরা। তাঁর পদত্যাগসহ নানা অনিয়মের তদন্তের দাবিতে ১২ দিন ধরে শিক্ষকেরা এই কর্মসূচি পালন করছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম আপাতত বন্ধ আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সহকারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার পদে উপাচার্যের ছেলে সৈয়দ তাহসিন আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) খান মো. ওলিয়ার রহমানের মেয়ে রওনক আরা আফরিন সেকশন অফিসার পদে, মেলান্দহ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামানের ছেলে ফয়সাল সরকার সেকশন অফিসার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহাম্মেদ চৌধুরীর মেয়ে ফাহমিদা চৌধুরী সেকশন অফিসার, মেলান্দহ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে মো. সোহাগ সরকারকে উপাচার্যের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

দলীয় নেতাদের সন্তানেরা চাকরি পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেলান্দহ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা সবাই দলীয়ভাবেই চাকরি পেয়েছেন। সেখানে কি কোন বিএনপির নিয়োগ হয়েছে? উপাচার্য যে নিয়োগ পেয়েছেন, তিনিও তো আওয়ামী লীগ করেন বলেই পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সময়, আওয়ামী লীগের সাপোর্ট এবং সহানুভূতি ছাড়া কারও চাকরি হবে না।’

নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম ছাড়াও উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকেরা আরও কিছু অভিযোগ তুলেছেন। এগুলো হলো পদোন্নতিতে অনিয়ম, অর্থের অপচয়, বিধিবহির্ভূতভাবে রাজশাহীতে নিজ বাসায় পরিবারের সদস্যদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি বরাদ্দ করা, প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও অনেক কর্মকর্তাকে মাসিক লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে ভাড়া করা গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া। বেশির ভাগ সময় তিনি ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থাকেন।

বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতেও বেশির ভাগ সময় তিনি ক্যাম্পাসে থাকেন না, ক্যাম্পাসে উৎপাদিত ধান, মাছ ও সবজি উপাচার্য নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের উন্নয়নের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৩০ জনকে ৪২০ টাকা করে প্যাকেট বিরিয়ানি খাওয়ানোসহ বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়ে ১২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে।

একটি মহল তাঁকেসহ তাঁর পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর সময়টা কঠিন থাকে। তিল তিল করে বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তুলেছি। চার বছর ধরে দায়িত্বে আছি। কখনো একটি দিনের জন্যও শিক্ষকেরা এসব অভিযোগ তোলেননি।

হঠাৎ তাঁরা এসব অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যে তাঁরা ১০টি দাবিদাওয়াও দিয়েছেন। আমি সেগুলো মেনে নিয়েছি।’ নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ডে আমি ছিলাম না। ফলে সেখানে আমার কোনো অনিয়ম করার সুযোগ নেই। সব আইন ও নিয়ম মেনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ হয়েছে।’

উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরে ৮ নভেম্বর জামালপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে শিক্ষকেরা সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এ এইচ এম মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের উন্নয়নে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। সেখানে উপাচার্য ৪ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছেন। যাঁরা প্রাধিকারভুক্ত নন, তাঁদের গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছেন। তাঁর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় আমরা অতিষ্ঠ।

আমরা তাঁর পদত্যাগ চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িগুলো তাঁর পরিবার এবং তাঁর বোনেরা ব্যবহার করছেন। ঢাকায় একটি গেস্টহাউস রয়েছে। কিন্তু সেখানে এক দিনের জন্যও একজন শিক্ষককে উপাচার্য থাকতে দেননি। এসব বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করেন শিক্ষকেরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্য সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর মেলান্দহে অবস্থিত জামালপুর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তাঁর বাড়ি রাজশাহীতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯৮ জন শিক্ষার্থী ও ৪৬ জন শিক্ষক এবং ৮১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। একই সময়ে প্রায় ৩০ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়। উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছেন শিক্ষকেরা।