আমাদের মেয়েদের জন্য শুভকামনা

ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচে গোলের পর বাংলাদেশের মেয়েদের উদ্‌যাপন। এমন উদ্‌যাপন সাবিনারা করতে চাইবেন আজও
ছবি: বাফুফে

আমরা আজ প্রার্থনা করছি বাংলাদেশের ফুটবলার মেয়েদের জয়ের জন্য। কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে আজ সোমবার বিকেলে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে আমাদের কন্যারা নামছেন নেপালের বিপক্ষে। আমাদের আন্তরিক প্রার্থনা, অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের হাতেই উঠুক সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি।

সেমিফাইনালে বাংলাদেশ ভুটানকে হারিয়েছে ৮-০ গোলে। সেমিফাইনালে ওঠার পথে বাংলার মেয়েরা ভারতকে ৩-০, পাকিস্তানকে ৬-০, মালদ্বীপকে ৩-০ গোলে হারিয়ে এসেছেন।

২০১৫ সালে প্রথম আলোয় কামরান পারভেজের লেখা ‘ফুটবল রাঙাচ্ছে কলসিন্দুরের মেয়েরা’ প্রতিবেদনটা ছিল আমাদের জন্য বিমুগ্ধ বিস্ময়! গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের রূপকথার গল্প জানতে পারি আমরা।

‘এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে ১৮ সদস্যের বাংলাদেশ দলে একসঙ্গে খেলার সুযোগ পায় কলসিন্দুরের ১০ কন্যা—মার্জিয়া আক্তার, সানজিদা আক্তার, নাজমা আক্তার, শিউলি আজিম, মারিয়া মান্দা, মাহমুদা আক্তার, লুপা আক্তার, শামছুন্নাহার, তাসলিমা ও তহুরা আক্তার।

বাংলাদেশ দলের কোচ গোলাম রব্বানী।

এর মধ্যে আটজন খেলেছে একাদশে।’ মেয়েদের সেই দলটি বয়সভিত্তিক নানা ম্যাচে একটার পর একটা জয় এনে দিতে থাকে দেশকে। কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয় বেগম ফজিলাতুন্নেছা কাপ টুর্নামেন্টে জাতীয়ভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েই চলে।

কলসিন্দুরের সেই মেয়েদের ঢাকায় এনে পাঁচতারা হোটেলে সংবর্ধনা দেয় প্রথম আলোপ্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তাঁরা। তাঁদের নিয়ে প্রথম আলো নির্মাণ করে রেদওয়ান রনি নির্দেশিত প্রামাণ্যচিত্র অদম্য মেয়েরা

অনূর্ধ্ব–১৪ সেই বালিকারা প্রজাপতির মতো উচ্ছল হয়ে ঘুরছিলেন আমাদের অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে। আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনারা যে আমাদের নিয়ে ছবি বানিয়েছেন, আমরা দেখব কী করে? আমাদের গ্রামে তো বিদ্যুৎ নেই।’ সে কথা আমি ফেসবুকে লিখলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সেই গ্রামের ৮০০ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আলোকিত হয়ে ওঠে এক দূরবর্তী শত বছরের আঁধারঘেরা গ্রাম।

কোথা থেকে কোথায়

বিদ্যুৎ দেওয়ার অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সেই গ্রামে গিয়েছিলাম আমিও। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি, কলসিন্দুর গ্রামের ১৯ ফুটবলার মেয়ের জন্য। পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গী দেশের অন্য অঞ্চল থেকে আসা আরও ছয়জন ফুটবলার মেয়েকে বৃত্তি দিতে থাকে প্রথম আলো। তারপর মেয়েরা এতটাই এগিয়ে যান যে তাঁদের আর প্রথম আলোর বৃত্তির প্রয়োজন থাকে না।

সেটাও একটা সুখবর। আপনারা জানেন, চিত্রনির্মাতা রেদওয়ান রনি যখন ২০১৫ সালে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলেন কলসিন্দুর গ্রামে, মেয়েদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তোমরা কী চাও? তারা বলেছিল, ‘এক বেলা ভালো করে খাওয়াবেন।’ আরও বেশি কিছু চাও‍—বলা হলে উত্তর এসেছিল, ‘বেশি করে খাবার দিয়ে দেন, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাব।’

সেই মেয়েরা আজ কত দূর এগিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের উপহার দিয়েছেন। ফুটবল ফেডারেশন তাঁদের বেতন দেয়। এই পরিবারগুলোর অনেকের সঙ্গে আমার এখনো যোগাযোগ আছে। ওঁদের এই অদম্য অগ্রযাত্রা আমাদের প্রাণিত করে। আমাদের আশাবাদকে শাণিত করে।

পরিকল্পনার ফসল

আমাদের নারী ফুটবলারদের এই দুর্বার জয়যাত্রার পেছনে আছে অনেক দিনের সাধনা, পরিকল্পনা, হাড়ভাঙা পরিশ্রম। প্রথম ধাপটা ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের জন্য বেগম ফজিলাতুন্নেছা কাপ টুর্নামেন্ট প্রবর্তন করা। একেবারে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের পায়ে ফুটবল তুলে দেওয়ার সেই তো শুরু।

কিন্তু সেই মেয়েদের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে থেকে জাতীয় দলে খেলতে নিয়ে আসার জন্য ফুটবল ফেডারেশন কাজ করতে থাকে অনেক আগে থেকে। গোলাম রব্বানী ২০০৮ সাল থেকে এঁদের কোচ। ২০১২ সাল থেকে কিশোরী ফুটবলারদের ঢাকায় ফুটবল ফেডারেশন ভবনে রেখে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়।

তখন কোনো স্পনসর ছিল না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নারী কমিটির চেয়ারপারসন মাহফুজা আক্তারের কাছ থেকে গতকাল শুনছিলাম সেই কঠিন সময়ের গল্প। মেয়েরা হোস্টেলে থাকছেন। তাঁদের খাবারের খরচ, পোশাকের খরচ, প্রশিক্ষণের খরচ, পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসার খরচ জোগাবে কে?

বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন আর মাহফুজা আক্তার নিজেদের গাঁটের টাকা থেকে এই ব্যয় নির্বাহ করতেন। তিন বছর পরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ঢাকা ব্যাংক আর ইউনিসেফ। জাপান থেকেও অর্থ সাহায্য খানিকটা জোগাড় করা হয়। তারও আগে, ২০০৮ সালে এএফসির বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পর, ট্যালেন্ট হান্ট কর্মসূচিতে সাহায্য করেছিল প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।

মেয়েরা ঘুম থেকে ওঠেন ভোর পাঁচটায়। তাঁদের প্রশিক্ষণের নানা ধাপ শেষ হয় সন্ধ্যা সাতটায়। বেশ ক বছর আগে এঁদের একজন পরিচালিকা আমাকে বলেছিলেন, ‘ঈদে বাড়ি গেলে মেয়েরা ফিটনেস নষ্ট করে আসবে।’ ‘কেন? বাবা-মা বেশি খাওয়াবে বলে?’ ‘না। উল্টোটা। ভালো খাবারের অভাবে স্বাস্থ্য নষ্ট করে আসবে।’ সে কথা মনে হলে আমার চোখ ভিজে আসে। সেই মেয়েরা আজ কেবল স্বাবলম্বী হয়েছেন তা–ই নয়, তাঁদের পরিবারেও সুদিন আনতে পেরেছেন।

বাফুফে ভবনেই আবাস

আমাদের মেয়েদের ফুটবল টিমের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি, যুক্তরাজ্য থেকে এসেছেন। আর কোচ হিসেবে আছেন গোলাম রব্বানী। মেয়েরা এবারের সাফ টুর্নামেন্টে একটা করে খেলা জিতেছেন, আর জয়ের কৃতিত্ব দিয়েছেন কোচকে। ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে এই টিম একসঙ্গে থাকছে, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, খেলছে। মতিঝিলের বাফুফে ভবনের চারতলা তাঁদের আবাস।

এই দলে কলসিন্দুর গ্রামের মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার আছেন। সিরাত জাহান স্বপ্নার বাড়ি রংপুর। আঁখির বাড়ি সিরাজগঞ্জ। অধিনায়ক সাবিনা, এরই মধ্যে দুটি হ্যাটট্রিক যাঁর এই টুর্নামেন্টে এবং মাসুরা সাতক্ষীরার মেয়ে। কৃষ্ণা টাঙ্গাইলের, মনিকা আর রুপনা রাঙামাটির। আনাই আর আনচিং যমজ বোন খাগড়াছড়ির। নীলুফার ইয়াসমিন কুষ্টিয়ার।

এই মেয়েদের ফুটবলের অগ্রযাত্রার একনিষ্ঠ অনুসারী প্রথম আলোর প্রতিবেদক বদিউজ্জামান। আমাদের হয়ে তিনি কথা বলেছেন কোচ গোলাম রব্বানীর সঙ্গে।

কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বলেছেন, ‘আমাদের মেয়েরা ফাইনালে খেলার জন্য প্রস্তুত। মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে ফিট তারা। ফাইনালে আমরা আমাদের পরিকল্পনামতো খেলব। নেপাল দল খুব শক্তিশালী। তবে আমার মেয়েরা ফাইনালের জন্য প্রস্তুত। যদি আমরা চার ম্যাচ বিশ্লেষণ করি, আমাদের মেয়েরা খুব ভালো খেলেছে।

‘ওরা চাপ নিচ্ছে না। ওরা নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলবে। ওরা কোনো গোল খায়নি, ভারতকে হারিয়েছে; মেয়েরা তাদের ওই আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে সেরা খেলাটাই খেলবে।’

জয় হোক বাংলাদেশের

অনূর্ধ্ব ১৩, ১৪-এর সেই মেয়েরা ১০টা বছর ধরে মা–বাবা ও গ্রাম ছেড়ে এসে একাগ্র সাধনা করছেন। নিচ্ছেন পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ। করছেন কঠোর পরিশ্রম। একসঙ্গে থেকে হেসেখেলে একটা অভিন্ন আত্মার দল হয়ে উঠেছেন। প্রচুর প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন।

সাধনা থেকেই সিদ্ধি আসে। স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে খেলাটা কঠিন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণই হবে এবং তা থেকেই আমাদের মেয়েরা আমাদের জন্য নিয়ে আসবেন জয়ের মুকুট। এই শুভকামনা আমরা কায়মনোবাক্যে করে চলেছি। জয় হোক বাংলাদেশের।