ঢাকা মহানগরে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ভোটের আগে ২৩৪ মামলা

অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে করা এসব মামলায় আসামি সাড়ে পাঁচ হাজার নেতা–কর্মী। বেশির ভাগ মামলার বাদী পুলিশ।

বিএনপি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের তিন মাসে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ২৩৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয় সাড়ে পাঁচ হাজার নেতা–কর্মীকে। অজ্ঞাতনামা আসামি আরও তিন হাজার।

গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়ের হওয়া এসব মামলার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোসহ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলার বাদীও পুলিশ।

বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে এসব মামলা করা হয়েছে। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও এমন অনেক মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে কাল্পনিক অভিযোগে মামলা হয়েছে বলেও দাবি করে আসছে বিএনপি।

বিএনপির দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ২৮ অক্টোবরের পর মামলা দেওয়া যেমন বেড়েছে, গ্রেপ্তারও বেড়েছে অনেক। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতি জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারা দেশে তাদের ২৭ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

থানা–পুলিশ ও আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, গত অক্টোবরে ঢাকায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৬০টি। এরপর নভেম্বরে ১৩৩টি এবং ডিসেম্বরে ৪১টি মামলা হয়েছে।

এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় ঢাকার বিভিন্ন থানায় মামলা হয় ৩৬টি। এসব মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলটির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

আরও পড়ুন

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের দিন নয়াপল্টন ও এর আশপাশের এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাণ্ডব চালিয়েছিলেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিএনপির নেতা–কর্মীদের নামে মামলা হয়েছে। মামলায় যাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, কেবল তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। নাশতকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার ঘটনার সঙ্গে যাঁদের সংশ্লিষ্টতা থাকবে, তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

বিএনপির দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ২৮ অক্টোবরের পর মামলা দেওয়া যেমন বেড়েছে, গ্রেপ্তারও বেড়েছে অনেক। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতি জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারা দেশে তাদের ২৭ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিএনপির এই তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশ ও আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে ২৮ অক্টোবর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রেপ্তারের যে তথ্য সংগ্রহ করা গেছে, তাতে দেখা যায়, এই সময়ে ঢাকায় বিরোধী দলের ৩ হাজার ১৫৬ জনকে গ্রেপ্তার হয়েছে। এই সময়ে পুলিশের ব্যাপক অভিযানের মুখে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় অংশই আত্মগোপনে চলে যায়।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কায়সার কামাল দাবি করেন, ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ পণ্ড করে নাশকতার দায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর চাপিয়ে একের পর এক রাজনৈতিক মামলা করেছে পুলিশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১ অক্টোবর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে সারা দেশে ৭৩৮টি মামলা হয়েছে।

এই তিন মাসে সর্বাধিক মামলা হয় যাত্রাবাড়ী থানায়—মামলার সংখ্যা ২৬। পল্টন থানায় ২২টি, রমনায় ১২টি, পল্লবীতে ১১টি, মিরপুরে ১১টি, মতিঝিলে ১০টি ও ডেমরা থানায় ৮টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

দলটির নেতাদের অভিযোগ, সরকার একপক্ষীয় নির্বাচন করার জন্য মামলা ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে বিরোধী দলের ওপর দমন–পীড়ন চালিয়েছে।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। নাশতকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার ঘটনার সঙ্গে যাঁদের সংশ্লিষ্টতা থাকবে, তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে।’

ঢাকার কোন থানায় কত মামলা

ঢাকা মহানগরে ৫০টি থানা রয়েছে। বিএনপির নেতাদের আইনজীবীদের তথ্য ও ঢাকার আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য বলছে, ১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার ৪৫টি থানায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ২৩৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে ৫ হাজার ৮৬৮ জনকে। এর বাইরে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও প্রায় ৩ হাজার জনকে।

এই তিন মাসে সর্বাধিক মামলা হয় যাত্রাবাড়ী থানায়—মামলার সংখ্যা ২৬। পল্টন থানায় ২২টি, রমনায় ১২টি, পল্লবীতে ১১টি, মিরপুরে ১১টি, মতিঝিলে ১০টি ও ডেমরা থানায় ৮টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

সাতটি করে মামলা হয়েছে খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, শাহ আলী ও কাফরুল থানায়। ছয়টি করে মামলা শ্যামপুর, দারুসসালাম, হাতিরঝিল, ভাটারা ও ওয়ারী থানায়। পাঁচটি করে মামলা হয় মোহাম্মদপুর, শেরেবাংলা নগর, কদমতলী ও মুগদা থানায়। চারটি করে মামলা হয় ধানমন্ডি ও সবুজবাগে। তিনটি করে মামলা হয় চকবাজার, বনানী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, বাড্ডা, হাজারীবাগ, উত্তরা পূর্ব, ভাষানটেক, রামপুরা ও গেন্ডারিয়ায় থানায়। দুটি করে মামলা লালবাগ, বংশাল, উত্তরা পশ্চিম, খিলক্ষেত, শাহবাগ, রূপনগর ও নিউমার্কেট থানায়। একটি করে মামলার তথ্য পাওয়া গেছে আরও সাতটি থানায়।

এই সময়ে পাঁচটি থানায় (কামরাঙ্গীর চর, গুলশান, উত্তরখান, আদাবর, তুরাগ থানা) বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।

ঢাকার আদালতে বিএনপির নেতা–কর্মীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন, এমন দুজন আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ইলতুৎমিশ সওদাগর। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, এমন প্রায় দুই শ নেতা–কর্মীকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগপর্যন্ত তাঁদের মক্কেলদের জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে। তবে নির্বাচনের পর অনেকে জামিন পেয়েছেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা–কর্মীদের রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করতে অতীতের মতো এবারও সরকার একের পর এক মামলা ও গ্রেপ্তার করেছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন

ভোটের দিন ককটেল বিস্ফোরণের মামলা

৭ জানুয়ারি ভোটের দিন ও এর আগের দিন বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে। দুটি মামলাই মতিঝিল থানায় হয়েছে। পুলিশের করা এই দুই মামলায় এজাহারে নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয় ২০ জনকে। অজ্ঞাতনামা আসামি ২৫ জন। দুই মামলায় মোট গ্রেপ্তার ১১ জন।

এর মধ্যে ৭ জানুয়ারি করা মামলাটিতে অভিযোগ করা হয়, ভোটের দিন দুপুরে মতিঝিলের টয়েনবি সার্কুলার রোডে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা নির্বাচন বানচালের জন্য ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। এই মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা–কর্মীদের রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করতে অতীতের মতো এবারও সরকার একের পর এক মামলা ও গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর দাবি, এই সরকার ফৌজদারি মামলাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নজির স্থাপন করেছে।