নিয়োগে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পরও বিটিআরসিতে বহাল তাঁরা

বিটিআরসি

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ১০৪ জনের নিয়োগে অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ থাকলেও কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। এসব নিয়োগ হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রতিবেদনে অনুসারে, বিভিন্ন পদে ১০৪ জনের নিয়োগ ও ১২ জনের পদোন্নতিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বিটিআরসিতে ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত এই নিরীক্ষা করে ডাক, টেলিযোগাযোগ, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি অডিট অধিদপ্তর। ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের রাজস্ব আদায় কার্যক্রমসহ মনিটরিং ব্যবস্থাপনার ইস্যুভিত্তিক নিরীক্ষা করে। যেখানে ৫৯টি বিষয়ে তারা আপত্তি জানিয়েছিল, যার মধ্যে ১৩টি অনুচ্ছেদ ছিল নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে।

এরপর এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে তদন্তে নামে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটি ২০২১ সালের ১১ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে বিটিআরসির নিয়োগ ও পদোন্নতিতে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। তবে সেখানে শাস্তির কোনো সুপারিশ করা হয়নি।

বিটিআরসির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেছেন, অডিট আপত্তি সঠিক হয়নি বলে তিনি মনে করেন, তবে সামান্য কিছু অনিয়ম হয়েছে। সেটার ব্যাপারে এখন যাঁরা আছেন, তাঁরা দেখবেন।

নিয়োগসংক্রান্ত এই ১৩ আপত্তির বিষয়ে বিটিআরসি অডিট অধিদপ্তরকে জবাব দিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে অডিট অধিদপ্তর তাদের মন্তব্য জানিয়ে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসিকে চিঠি দেয়। দুটি চিঠির অনুলিপি ঘেঁটে দেখা যায়, অডিট অধিদপ্তর শাস্তিসহ অর্থ ফেরত দিতে অনুরোধ করেছে।

গত মাসের ১৪ তারিখ চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন মো. মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনের বাইরে কেউ নন। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ

চিঠিতে অডিট অধিদপ্তর বলেছে, নিয়োগ বিধি উপেক্ষা করে ২৯ জন জুনিয়র পরামর্শককে রাজস্ব খাতে বিভিন্ন পদে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়োগ নিয়ে বিটিআরসি যে জবাব দিয়েছে, তা সহায়ক নয়। কারণ, প্রকল্পে নিযুক্ত পদগুলোয় কর্মরত ব্যক্তিদের বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেওয়ার বিধান নেই। এই পদগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ আপত্তি করা পরিশোধিত বেতন–ভাতাসহ অন্যান্য অর্থ আদায়পূর্বক কমিশনের তহবিলে জমা দিয়ে অডিট অধিদপ্তরকে জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে।

দুই বছর আগে করা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এই ২৯ জনের নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, এই ২৯ জনের মধ্যে ১৫ জন প্রার্থীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না।

অডিট অধিদপ্তর আরেকটি চিঠিতে বলেছে, নিয়োগ বিধি উপেক্ষা করে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত (সরকারি পেনশনভোগী) ১৭ জন কর্মচারীকে রাজস্ব খাতে চালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগের আপত্তির বিপরীতে বিটিআরসি যে জবাব দিয়েছে, তা নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়।

অডিট অধিদপ্তর বলেছে, নিয়োগ করা ব্যক্তিদের নিয়োগবিধির শর্তাদি (বয়স) পূরণ না করে নিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি নিয়োগ কার্যক্রমটি বিটিআরসির ৮৫তম সভার মাধ্যমে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে, যা বিধিসম্মত নয়। এই নিয়োগের ক্ষেত্রেও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ আপত্তি করা পরিশোধিত বেতন–ভাতাসহ অন্যান্য অর্থ আদায়পূর্বক কমিশনের তহবিলে জমা দিয়ে অডিট অধিদপ্তরকে জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে।

এই ১৭ চালকের নিয়োগের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে বিটিআরসি দুটি পত্রিকায় একই পদের জন্য দুই ধরনের বয়সসীমা চেয়েছিল। যাতে বিটিআরসির স্বেচ্ছাচারিতা প্রমাণিত হয়। তদন্ত কমিটি আরও বলেছে, সব আবেদনকারীর বয়স বিবেচনা না করে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ১৭ জনকে বিভাগীয় প্রার্থী দেখিয়ে বয়স প্রমার্জন (২৪ বছর পর্যন্ত) করে চালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কমিটি বলেছে, এখানে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা না হওয়ায় বিটিআরসির চাকরি প্রবিধানমালা ২০০৯ লঙ্ঘিত হয়েছে।

নিয়োগে আরও অনিয়ম

বয়স প্রমার্জন ক্ষেত্রে সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে ৩০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্ট্রেংদেনিং দ্য রেগুলেটরি ক্যাপাসিটি অব বিটিআরসি প্রকল্পের ২১ কর্মচারীকে রাজস্ব খাতের বিভিন্ন স্থায়ী পদে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

চাকরিবিধি উপেক্ষা করে জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক পদে দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যাঁদের একজন বর্তমানে পরিচালক এবং আরেকজন উপপরিচালক হিসেবে বিটিআরসিতে আছেন।

শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তিনজনকে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বলছে, তাঁদের আবেদন বাতিলযোগ্য। এই তিনজনই এখন উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং একজন একটি প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন।

নির্ধারিত পদের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও একজনকে সহকারী পরিচালক হিসেবে ২০১১ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি এখন সহকারী পরিচালক পদে কর্মরত।

সংস্থাটিতে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিভিন্ন পদে নিয়োগের বিষয়ে অডিট দল ও তদন্ত কমিটিকে সন্তোষজনক নথি সরবরাহ করতে পারেনি বিটিআরসি। তাই এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান প্রথম আলোকে জানান, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। বিটিআরসি যেহেতু কমিশন, তাই মন্ত্রণালয় তাদের সহযোগিতা বাদে অন্য কোনো ভূমিকায় যায় না। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে কোনো ভূমিকা রাখা যায় কি না, তা দেখবেন বলে জানান।

পদোন্নতিতেও অনিয়ম

শুধু নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, বিটিআরসি পদোন্নতির বেলাতেও অনিয়ম করেছে বলে অডিট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। বলা হচ্ছে বিধিবহির্ভূতভাবে ১২ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

একজনকে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার পরও সহকারী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

পদোন্নতির শর্ত (চার বছরের নির্দিষ্ট সময়সীমা) পূরণ না হওয়ার পরও তিনজনকে ২০১৪ সালে উপপরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই তিনজনই এখন বিটিআরসির গুরুত্বপূর্ণ তিন বিভাগের পরিচালক পদে আছেন।

শিক্ষাগত যোগ্যতা ও নির্ধারিত বয়স না থাকা সত্ত্বেও একজন সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তাঁকে চাকরি স্থায়ীও জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতিও দেওয়া হয়।

অডিট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় বলেছে, বিটিআরসি সরকারি বিধি উপেক্ষা করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রণয়ন করায় পদোন্নতি প্রদানে অনিয়মের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।