তুরস্ক থেকে সমরাস্ত্র কেনা বেড়েছে

কেনাকাটার তালিকায় রয়েছে বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন, সুরক্ষাকারী যান, সাঁজোয়া যান ও বহুমাত্রিক রকেট প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

তুরস্কের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্বে মনোযোগ বাংলাদেশের।

গত পাঁচ বছরে আলোচিত বাইরাকটার টিবি২ ড্রোনসহ অন্তত ১৫ ধরনের আধুনিক সমরাস্ত্র কিনেছে বাংলাদেশ

তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর দেশটির কাছ থেকে সমরাস্ত্র কেনা বেড়েছে বাংলাদেশের। গত পাঁচ বছরে আলোচিত বাইরাকটার টিবি২ ড্রোনসহ অন্তত ১৫ ধরনের আধুনিক সমরাস্ত্র কিনেছে বাংলাদেশ। ঢাকা ও আঙ্কারার কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ২০১৮ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে সমরাস্ত্র কেনাকাটা এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকার আভাস রয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে সমরাস্ত্র কেনাকাটা এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে।

ঢাকা ও আঙ্কারার কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে ড্রোনসহ নানা ধরনের সমরাস্ত্র বিক্রিসহ রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বেড়েছে। ফলে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়ে তুরস্কেরও কৌশলগত সহযোগিতায় আগ্রহ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে এ বছর বাংলাদেশকে একটি খসড়া পাঠিয়েছে তুরস্ক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের একাধিক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি সই হলে দুই দেশের সম্পর্কের কৌশলগত অংশীদারত্বে উত্তরণ অর্থবহ হবে। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার হবে।

তুরস্কের নেতৃত্বের কাছে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আমরা আশা করছি, এই সম্পর্ক অচিরেই কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত হবে।
এম আমানুল হক, তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত, চীন ও জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব রয়েছে। যদিও ভারতের সঙ্গে অংশীদারত্বকে কৌশলগত সহযোগিতার চেয়ে বেশি কিছু বিবেচনা করে বাংলাদেশ।

তুরস্ক থেকে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, গত মে মাসে কাতার সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে অংশ নেন। সেখানে তিনি তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কৌশলগত উত্তরণের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ আরব বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভারসাম্যগত অবস্থানের স্বার্থে তিনি তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার কথা বলেন।

প্রসঙ্গত গত ২৯ মে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানিয়ে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই দেশের সম্পর্কের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা লিখেছেন, আপনার নেতৃত্বে বলিষ্ঠ এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শুধু নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে না, এটি কৌশলগত অংশীদারত্বের পথে এগিয়ে যাবে।

তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আমানুল হক গত রাতে আঙ্কারা থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসা, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষার পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলা এবং রোহিঙ্গা সংকটের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে। তুরস্কের নেতৃত্বের কাছে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আমরা আশা করছি, এই সম্পর্ক অচিরেই কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত হবে।

আরও পড়ুন

গুরুত্ব বেড়েছে প্রতিরক্ষায়

চিরাচরিত যুদ্ধে ড্রোন কীভাবে নিয়ামক ভূমিকা রাখে, ২০২০ সালে নাগোরনো–কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার লড়াইয়ে সেটি প্রমাণিত হয়েছিল। এবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সুবিধাজনক অবস্থায় যেতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে তুরস্কের তৈরি বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন। বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন বিপাকে ফেলে রুশ বাহিনীকে। গত বছর ওই ড্রোন কিনতে তুরস্কের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাইকার টেকনোলজির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী।

তুরস্কের কাছ থেকে বাংলাদেশের সমরাস্ত্র কেনাকাটার বিষয়টি প্রথম জনসমক্ষে আনেন দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত সাভাসগলু। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ওই সফরের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর তিনি বাংলাদেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি করতে তুরস্কের আগ্রহের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।

তুরস্কের সরকারি সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রকেটসানের সঙ্গে বাংলাদেশ ২০২১ সালের জুনে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। রকেটসান ন্যাটোর মানদণ্ড অনুযায়ী, স্থল, সমুদ্র ও আকাশে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র তৈরি করে থাকে।

আরও পড়ুন

গত পাঁচ বছরের কেনাকাটা

সমরাস্ত্র বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপরি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ইতিমধ্যে আঙ্কারা থেকে কোবরা আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার ও শর্ট-রেঞ্জ মিসাইল কিনেছে।

কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে, দুই দেশের বিদ্যমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় তুরস্ক নির্মিত মাইন থেকে সুরক্ষাকারী যান, সাঁজোয়া যান এবং বহুমাত্রিক রকেট প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত কামানের গোলা বিক্রির বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কাছে সামরিক হেলিকপ্টার ও ট্যাংক বিক্রিতে আগ্রহী তুরস্ক। তুরস্কের একটি কোম্পানি বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে শেল বানানোর প্রযুক্তি দিয়েছে। এ ছাড়া নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের টহল নৌযান তৈরির জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে তুরস্ক থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সমরাস্ত্র কিনেছে। ওই বছর গ্রাউন্ডেড সার্ভিলেন্স রাডার, কৌশলগত সাঁজোয়া যান কোবরা ২–সহ কয়েক ধরনের সাঁজোয়া যান, বহনযোগ্য জ্যামার কেনা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে অফশোর ক্রেন, সাঁজোয়া যান এবং অ্যাম্বুলেন্স, মিসাইল লঞ্চিং সিস্টেম, ওরলিকন স্কাই গার্ড রাডার সিস্টেমসহ নানা ধরনের সমরাস্ত্র কেনাকাটা হয়েছে।

আঙ্কারার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্তত তিন হাজার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাকে তুরস্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স, পুলিশ ও আনসারের আরও সাতটি প্রতিনিধিদল বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ নিয়েছে তুরস্কে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গর্ভন্যান্সের জ্যেষ্ঠ ফেলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমরাস্ত্র সংগ্রহে বৈচিত্র৵ আনতে হলে তুরস্ক বেশ ভালো একটি বিকল্প। ন্যাটোর সদস্য তুরস্কের সমরাস্ত্র মানে ভালো এবং দামেও সাশ্রয়ী। ড্রোন ও মিসাইলের মতো সমরাস্ত্র দেশটি নিজেদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন করে। তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিনিময়েরও সুফল পেতে পারে।