কর্মকর্তাদের ভবন ব্যবসায়ীকে ভাড়া দিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্মকর্তাদের আবাসন নিশ্চিত করতে চারতলা ভবনটি নির্মাণ করেছিল। নির্মাণকাজ শেষ হলেও ফ্ল্যাটগুলো কর্মকর্তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। আয় বাড়াতে কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত ভবনটি এক ব্যক্তিকে ২৫ বছরের জন্য ভাড়া দিয়েছে সিটি করপোরেশন। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই চুক্তি হয়। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের কে বি আবদুচ ছত্তার সড়কের রহমতগঞ্জ এলাকায় চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে ২০০৮ সালে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। তবে ভবনের চারতলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ২০১৬ সালে। পুরোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পাশের কুসুমকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শ্রেণিকার্যক্রম চারতলা ভবনটিতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। তবে গত বছরের শুরুর দিকে নতুন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় বিদ্যালয়টির কার্যক্রম।
এক উদ্দেশ্যে ভবন নির্মাণ করে অন্য উদ্দেশ্যে আগেও ব্যবহার করেছিল সিটি করপোরেশন। নগরের টাইগারপাসে বস্তিবাসীদের জন্য সাততলা ভবন নির্মাণ করেছিল। কিন্তু বস্তিবাসীদের বরাদ্দের অ্যাপার্টমেন্ট তাঁদের বুঝিয়ে না দিয়ে সেখানে প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করে সিটি করপোরেশন। এখনো তা চলছে। বস্তিবাসীদের অ্যাপার্টমেন্ট বুঝিয়ে দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত ভবন বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত হয়েছিল কি না, তা তাঁর জানা নেই। তবে ওখানে একটি বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম চলত। বিদ্যালয়টি নিজস্ব ভবনে চলে যাওয়ার পর এই ভবনটি খালি পড়ে ছিল। তাই আয় বাড়াতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পদে ২৮৫ কর্মকর্তা কর্মরত। আর নগরের বিভিন্ন এলাকায় ৯টি ভবনে অন্তত ৬০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব ফ্ল্যাটে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা যেমন থাকেন, তেমনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও আছেন।
কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাটে চলবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনসংকট রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি ভবনে অল্প পরিমাণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন নিশ্চিত করলেও অধিকাংশই থাকেন বাইরে।
সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আবাসন সমস্যা দূর করতে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী রহমতগঞ্জ এলাকায় আটতলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে তাঁর আমলে এর কাজ শেষ হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতে আন্দরকিল্লার নগর ভবনের কাছাকাছি এলাকায় থাকতে পারেন, এ জন্য এই ভবন করা হয়। আগে সেখানে দোতলা ভবনে দুজন কর্মকর্তা থাকতেন। দোতলা ভবন ভেঙে আটতলা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে।
ভবনের নির্মাণকাজে যুক্ত সিটি করপোরেশনের এক প্রকৌশলী (বর্তমানে অবসরে আছেন) নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কর্মকর্তাদের জন্য। প্রতি তলায় তিনটি করে ফ্ল্যাট রাখা হয়। আর্থিক সংকটে কাজ করতে অনেক সময় লেগে যায়। আটতলার মধ্যে চারতলার নির্মাণকাজ শেষ হলে সেখানে কুসুমকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় স্থানান্তর করা হয়। এরপর ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা যায়নি।
সিটি করপোরেশন পরিচালিত কুসুমকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় নিজস্ব ভবনে ফিরলেও প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে খালি পড়ে ছিল কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত ভবনটি। এর মধ্যে নিজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য ভবনটি ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ভবনটি ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নগরের হালিশহর হাউজিং এস্টেটের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. সাইফুদ্দিন চৌধুরীকে ২৫ বছরের জন্য ভবনটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ৩ সেপ্টেম্বর সাইফুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে চুক্তি করে সিটি করপোরেশন।
এদিকে চুক্তি করা ভবনটি ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন সাইফুদ্দিন চৌধুরী। এ জন্য ভবনটিতে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। ভবনের দোতলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ব্যাংক, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হবে বলে সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে। নিচতলা গাড়ি রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
আজ রোববার সকালে সরেজমিনে এই দৃশ্য দেখা যায়। এ সময় ভবনের মূল প্রবেশ ফটকে তালা দেওয়া ছিল। তাই ভেতরে প্রবেশ করা যায়নি। আর বাইরে থেকে দেখা যায়, ভবনের বিভিন্ন কক্ষে লাগানো কাচ ভেঙে পড়েছে। ভবনের দেয়ালে শেওলা জন্মেছে। ভবনের ছাদে পরগাছাও দেখা যায়।
সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ভবনটি ১০ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর নির্মিত। প্রথম থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ৩০ হাজার বর্গফুট জায়গা এক ব্যক্তিকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ওই ব্যক্তির কাছ থেকে উন্নয়ন চার্জ হিসেবে ৬৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে, যা অফেরতযোগ্য। আর প্রতি মাসে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে সিটি করপোরেশনকে ভাড়া দেবে। ১০ বছর পর ভাড়া বৃদ্ধি পাবে।
কর্মকর্তাদের ক্ষোভ
নগরের বিভিন্ন সংস্থা কর্মকর্তাদের জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করলেও তাতে পিছিয়ে রয়েছে সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে আবাসনের জন্য নির্মিত ভবন বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়ায় ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। চাকরির বিধি ভঙ্গের আশঙ্কায় কর্মকর্তাদের কেউ নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে রাজি হননি। এ নিয়ে প্রকৌশল বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, শিক্ষা বিভাগের ১০ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়।
নির্ধারিত ভবন ব্যবসায়ীকে ভাড়া দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, কর্মকর্তাদের জন্য এমনিতেই আবাসনের ব্যবস্থা নেই। সিটি করপোরেশনের কাজের কৌশলগত কারণে কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত থাকে। নির্দিষ্ট কলোনি বা কোয়ার্টার না থাকায় সবাইকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয়। এ ছাড়া বাড়তি ভাড়াও দিতে হয়। এ অবস্থায় নির্ধারিত ভবনটি বাণিজ্যিকভাবে অন্য একজনকে ভাড়া দেওয়া খুব বাজে দৃষ্টান্ত হলো। এটি একধরনের জালিয়াতি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চৌধুরী সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের ভবন কেন অন্যজনকে ভাড়া দিয়েছে, তা রাজস্ব বিভাগ ভালো বলতে পারবে। আর কর্মকর্তাদের ভাড়া দিলে তো তাঁদের থেকে একটি নির্দিষ্ট টাকা কেটে রাখা হতো। এটা তো সিটি করপোরেশনের আয়।