বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে মাংস বিক্রি, দিচ্ছেন ৬৮০ টাকা কেজি

চট্টগ্রাম নগরের বালুছড়া এলাকায় দুই তরুণের মাংসের বাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েও কম টাকায় মাংস বিক্রি করে লাভ করছেন তাঁরা
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেশির ভাগ তরুণের স্বপ্ন থাকে পরিপাটি হয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবেন। কিন্তু ব্যতিক্রম চট্টগ্রামের দুই তরুণ। রাস্তার পাশে বসে তাঁরা বিক্রি করেন গরুর মাংস। তা-ও বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে। প্রতি কেজি ৬৮০ টাকায়। বাজারে যা বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৯০০ টাকায়। প্রতি শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বিক্রি হয় এই মাংস নগরের বালুছড়া এলাকায়।

দুই তরুণ হলেন, রাফিউল হাসনাত ও সাজ্জাদুর রহমান ওরফে সাকিব। রাফিউল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) এবং সাজ্জাদ চট্টগ্রামের বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিবিএ সম্পন্ন করেছেন সম্প্রতি।

নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার বালুছড়া বাজারে গত ২৭ অক্টোবর সকাল সাতটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে বসে গরুর মাংস বিক্রি করছেন দুই তরুণ। সামনে ক্রেতাদের ভিড়। ছোট ব্যানারে লেখা ‘মিট বাজার’। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দেওয়ার পর একজন ক্রেতা বিষয়টি খেয়াল করেন। তখন মুশফিকুর রহমান নামের ওই ক্রেতা বলেন, ‘তাঁরা (দুই তরুণ) কিন্তু কসাই নন। আমি আগেও বেশ কয়েকবার তাঁদের কাছ থেকে মাংস কিনেছি। প্রতি কেজির দাম ৬৮০ টাকা। প্রত্যেক কেজিতে ৭৫০ গ্রাম মাংস ও হাড় ২৫০ গ্রাম। দাম কম ও ভালো পাওয়ায় আবার নিতে এসেছি।’

একটি বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মুশফিকুর রহমান জানান, দুই তরুণকে উৎসাহ দিতে প্রতি সপ্তাহে মাংস কেনেন। বাজারের মাংসের সিন্ডিকেট ভাঙতে তাঁদের উৎসাহিত করা উচিত।

অস্থায়ী এই দোকানের সামনে দেখা গেছে, ক্রেতাদের বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। নগরের অক্সিজেন থেকে মাংস নিতে এসেছেন আবদুল মান্নান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজার থেকে গরুর মাংস কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। তাই এখান থেকে আধা কেজি মাংস নিয়েছি। অনেক দিন পর গরুর মাংস খাব।’

গত আগস্ট থেকে মাংস বিক্রি শুরু করেন দুই তরুণ। জানতে চাইলে সাজ্জাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষ গরুর মাংস বেশি পছন্দ করে। কিন্তু দাম বাড়ার কারণে মানুষের পাতে এখন পছন্দের সেই খাবার জোটে না। বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে মানুষ জিম্মি হয়ে আছে। মানুষ যাতে মাংস খেতে পারেন, সেই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দুই বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করি মাংস বিক্রির। বগুড়া, নাটোরসহ উত্তরবঙ্গ থেকে বড় বড় গরু নিয়ে আসি। বিক্রি করে তাঁদের টাকা পরিশোধ করি। প্রতি শুক্রবার ৪০ মণের মতো মাংস বিক্রি হয়। এতে ৪০ হাজার টাকা লাভ থাকে।’

শুরুতে তাঁরা দুজন থাকলেও মাংসের চাহিদা থাকায় এখন ১৫ থেকে ২০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। কেউ মাংস কাটেন, আর কেউ প্যাকেট করেন। আর কেউ টাকা নেন।

শুরুতে দুজনকে কসাইসহ নানাভাবে বন্ধুবান্ধবসহ অনেকে ঠাট্টা করতেন বলে জানান রাফিউল হাসনাত। তিনি বলেন, তাঁরা এগুলো গায়ে মাখতেন না। একটাই লক্ষ্য ছিল, সামনে এগিয়ে যাওয়া। আগে থেকে তাঁরা দুজন পারিবারিক ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। এখন অনেকে তাঁদের বাহবা দেন। অনেকে তাঁদের মতো মাংস বিক্রির জন্য পরামর্শ নেন। কয়েকজন চালু করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

তরুণদের উদ্দেশে দুজনের একটাই কথা, কাজ কাজই। কোনো কাজই ছোট নয়। মানুষ কসাই বলুক আর যা-ই বলুক। সহনীয় দামে মাংস বিক্রি করেও তাঁদের লাভ হচ্ছে, ব্যবসায় কোনো লোকসান নেই। ‘বেশির ভাগই বিক্রি, ন্যূনতম লাভ’—এটিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন।

দুই তরুণ বালুচড়ার যে এলাকায় মাংস বিক্রি করেন, সেই এলাকায় থাকেন হাটহাজারীর কাটিরহাট মহিলা ডিগ্রি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক সায়মুন নাহার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত তিনি মাংস কেনেন। এই তরুণদের মতো প্রত্যেক এলাকার তরুণেরা এগিয়ে এলে মাংসের সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। সহনীয় দামে মানুষ মাংস খেতে পারবে।