সঠিক পরিকল্পনায় ফুসফুস ক্যানসারের চিকিৎসা হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমিয়ে আনা সম্ভব

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ৫ নভেম্বরছবি: প্রথম আলো

ফুসফুস ক্যানসারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা হলো বায়োপসি। এতে আক্রান্ত টিস্যু সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করা হয়, যা ক্যানসারের ধরন ও প্রকৃতি নিশ্চিত করে। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এই ক্যানসারের চিকিৎসা হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমিয়ে আনা সম্ভব।

‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজির সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আরমান রেজা চৌধুরী। উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন। ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে এসকেএফ অনকোলজি।

এবারের আলোচনায় ফুসফুস ক্যানসার নির্ণয়, স্টেজিং, চিকিৎসাপদ্ধতি এবং রোগীর জন্য নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, প্রতিরোধ ও ফলাফল তুলনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন চিকিৎসক। পর্বটি গত বুধবার (৫ নভেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থাপক জানান, বিশ্বব্যাপী ফুসফুস ক্যানসার সবচেয়ে সাধারণ ক্যানসারগুলোর একটি। এ কারণে এ রোগ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নানামুখী গবেষণা ও চিকিৎসা উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা। গ্লোবোকানের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। তবে আশার বিষয় হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারলে ফুসফুস ক্যানসার রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৬৫ শতাংশের বেশি।

এক্স-রে দিয়ে কি ফুসফুস ক্যানসার ধরা যায়? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, এক্স-রে সহজলভ্য এবং প্রাথমিক স্ক্রিনিংয়ে ব্যবহার করা হয়, তবে সব সময় ফুসফুস ক্যানসার ধরা যায় না। বিশেষ করে ছোট বা এমন স্থানে থাকা টিউমার যেটি এক্স-রে ইমেজে স্পষ্ট দেখা যায় না, তা মিস হতে পারে। নিশ্চিত ডায়াগনসিসের জন্য সিটি স্ক্যান বা পেট-সিটি স্ক্যান প্রয়োজন।

সিটি স্ক্যান ও পেট-সিটি স্ক্যানের পার্থক্য প্রসঙ্গে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, সিটি স্ক্যান টিউমারের আকার, অবস্থান ও আশপাশের কাঠামো দেখায়। পেট-সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে টিউমারের ফাংশনাল তথ্য বা কোষের সক্রিয়তা বোঝা যায়। এতে ক্যানসার কতটা সক্রিয় এবং শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়েছে কি না, তা জানা যায়। পেট-সিটি সবচেয়ে নির্ভুল, তবে ব্যয়বহুল।

ব্রঙ্কোস্কপি বা ফাইবার অপটিক টেস্ট কেন করা হয়? জবাবে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, এটি সেন্ট্রাল ফুসফুস ক্যানসারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শ্বাসনালির ভেতরে ক্যামেরা প্রবেশ করিয়ে টিউমার দেখা যায় এবং সরাসরি বায়োপসি নেওয়া সম্ভব। পেরিফেরাল বা দূরবর্তী টিউমারের জন্য সাধারণত সিটি-গাইডেড কোর বায়োপসি ব্যবহার করা হয়।

পাশাপাশি মলিকিউলার বা জিন টেস্টের গুরুত্ব নিয়ে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, বায়োপসির পর ক্যানসারের ধরন ও ড্রাইভার মিউটেশন বোঝার জন্য এটি প্রয়োজন। ‘পিডি-এল১’ বা অন্যান্য জিন টেস্ট অনুযায়ী নির্দিষ্ট টার্গেটেড থেরাপি দেওয়া যায়, যা চিকিৎসার কার্যকারিতা বাড়ায় এবং অপ্রয়োজনীয় কেমোথেরাপি এড়ায়। এখন এই টেস্টগুলো বাংলাদেশে সম্ভব।

এ পর্যায়ে টিস্যু বায়োপসি ও লিকুইড বায়োপসির পার্থক্য সম্পর্কে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, টিস্যু বায়োপসি মূল এবং নির্ণয়ের ভিত্তি। তবে কখনো রোগটি এমন স্থানে থাকে, যেখানে বায়োপসি ঝুঁকিপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে লিকুইড বায়োপসি রক্তের নমুনা থেকে ক্যানসারের তথ্য ও মলিকিউলার পরিবর্তন শনাক্ত করতে সাহায্য করে।

ফুসফুস ক্যানসারের স্টেজিং কীভাবে নির্ধারণ করা হয়? উত্তরে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, প্রথমে বায়োপসি দিয়ে ক্যানসারের ধরন নিশ্চিত করা হয়। এরপর বুক, পেট, মস্তিষ্কের সিটি/এমআরআই ও পেট-সিটি স্ক্যান মিলিয়ে আমেরিকান জয়েন্ট কমিটি অন ক্যানসার (এজেসিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী স্টেজ নির্ধারণ করা হয়। প্রতিটি স্টেজ অনুযায়ী চিকিৎসাপদ্ধতি ভিন্ন।

উপস্থাপক জানতে চান কেমোথেরাপি কখন প্রয়োজন হয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী? উত্তরে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘স্টেজ অনুযায়ী কেমোথেরাপি প্রি-অপারেটিভ বা পোস্ট-অপারেটিভ দেওয়া হয়। এর সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে খাওয়ার অরুচি, বমি ভাব, ক্লান্তি, চুল পড়া, রক্তের কণিকা কমা। আধুনিক ওষুধে এগুলো অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

কেমোথেরাপি ছাড়া ফুসফুস ক্যানসারের আর কী চিকিৎসা আছে? উত্তরে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘সার্জারি, ইমিউনোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন এসবিআরটি দিয়ে আর্লি স্টেজেও সফল চিকিৎসা সম্ভব।’ সঙ্গে রেডিওথেরাপি শুরু করার আগে প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, সিটি সিমুলেশন, প্ল্যানিং ও প্রেসক্রিপশন, মেডিকেল ফিজিসিস্ট প্ল্যান, অনকোলজিস্ট অনুমোদন ও প্রতিদিনের চিকিৎসা—এই প্রস্তুতিগুলো ক্রমান্বয়ে নিতে হবে। আর এ পুরো প্রক্রিয়া ৫-৭ দিনের মধ্যে শেষ হয়।

বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, রোগনির্ণয়, ডায়াগনসিস ও চিকিৎসাসুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. আরমান রেজা চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো

এসবিআরটি ডোজ ও ফ্র্যাকশন কীভাবে নির্ধারণ হয় এবং টিউমার নিয়ন্ত্রণে কী ভূমিকা রাখে? এ প্রসঙ্গে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, রোগীর অবস্থা, টিউমারের আকার ও অবস্থান বিবেচনা করে অনকোলজিস্ট নির্ধারণ করেন। উচ্চ ডোজ নির্ভুলভাবে টিউমারে কেন্দ্রীভূত হয়, আশপাশের সুস্থ টিস্যু রক্ষা হয়। ফলে টিউমার নিয়ন্ত্রণের হার বেশি এবং চিকিৎসার সময় কম হয়।

পেট-সিটি বা এমআরআই ফিউশন কেন গুরুত্বপূর্ণ? উত্তরে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, টিউমার স্পষ্টভাবে দেখা যায়, ড্র ও টার্গেটিং প্রিসাইজ হয়, আশপাশের টিস্যু কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্ক বা স্পাইন মেটাস্টেসিসে এমআরআই ফিউশন ব্যবহার করা হয়।

রেডিওথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা কী? উত্তরে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হলো গিলতে/খেতে কষ্ট, অরুচি, বমি, অবসাদ। এ জন্য রোগীকে চিকিৎসার আগেই ডাক্তাররা এ ব্যাপারে সচেতন করেন। তবু প্রতি সপ্তাহে রেডিয়েশন রিভিউ, ব্লাড টেস্ট, প্রয়োজনমতো ওষুধ সেবন করতে হবে রোগীকে।

রেডিয়েশন শেষে ফলোআপের সময় প্রসঙ্গে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ৪-৬ সপ্তাহে প্রথম চেক, ৩ মাসে ইমেজিং। প্রয়োজন হলে পুনরায় রেডিয়েশন দেওয়া হয়।

উপস্থাপক জানতে চান, এসবিআরটি ফলাফল কেমো বা টার্গেটেড থেরাপির সঙ্গে তুলনা করা যায় কীভাবে? জবাবে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, সরাসরি তুলনা কঠিন। রোগীর স্টেজ, হিস্টোলজি ও চিকিৎসার ধরন অনুযায়ী ফলোআপ করা হয়। মূল লক্ষ্য প্রত্যেক রোগীর জন্য নির্ধারিত থেরাপি অনুযায়ী ফলাফল নিরীক্ষণ করা।

ভিমট, আইএমআরটি, আইজিআরটি, সাইবারনাইফ ব্যবহারে রোগীর কী সুবিধা হয়? উত্তরে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, টিউমারে সঠিক ডোজ পৌঁছায়, আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রক্ষা হয়। এগুলোতে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বেশি কার্যকারিতা, প্রিসাইজ (নিখুঁত) ও নিরাপদ চিকিৎসা সম্ভব। এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ফুসফুস ক্যানসার চিকিৎসার ফলাফল উন্নত হয়।