ট্র্যাজেডি পিছু ছাড়ছে না রুহুল আমিনের

২০ বছর আগে হারিয়েছেন ছেলেকে। আর গতকাল মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী। আজ বেলা দুইটায় রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের সওদাগর পাড়ায়প্রথম আলো

২০ বছর আগের কথা। রুহুল আমিন (৫৮) তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতপ্রবাসী। হঠাৎ বাড়ি থেকে টেলিফোন আসে। খবর পান তাঁর বড় ছেলে মুহাম্মদ রিয়াদ হোসেন (৩) পুকুরে ডুবে মারা গেছে। এরপর তাঁর অনেক দিন কেটেছে বিষণ্নতায়। ১০ বছর আগে তিনি দেশে এসে বাড়ির সামনের বাজারে মুদিদোকান খোলেন। ভালোই চলছিল সংসার। এক বছর আগে রাতে চুলার আগুন থেকে তাঁর আধা পাকা বসতঘর পুড়ে ছাই হয়। এরপর বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে জমি কিনে একতলা নতুন পাকা বাড়ি তোলেন তিনি। তার সামনেই করেন মুদিদোকান। সেখানে বসে মালামাল বিক্রি করতেন। ব্যবসা আগের চেয়েও ভালো চলছিল।

এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার তাঁর বড় মেয়ে রুমা আকতার (২০) রান্না করতে গেলে চুলার আগুনে তাঁর শরীরের কিছু অংশ ঝলসে যায়। দেরি না করে রুহুল আমিন ও তাঁর স্ত্রী রোজী আকতার (৪৫) মেয়ে রুমা আকতারকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালের রওনা হন। পথে তাঁদের বহনকারী সিএনজি অটোরিকশাটিকে চাপা দেয় একটি ইটবাহী ট্রাক। এতে বাবা, মা, মেয়ে—তিনজনই আহত হন। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে নিয়ে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাতে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্ত্রী রোজী আকতার।

এরপর রুহুল আমিন যেন আবারও জীবনের অতল গহ্বরে পড়ে গেলেন। চোখেমুখে তিনি আর কিছু দেখছেন না। এর আগে তিনি প্রবাসে থাকার সময় পা পিছলে পড়ে যান। সেই পা সারেনি এখনো। পায়ে ব্যথা নিয়েই এখনো হাঁটেন তিনি।

এভাবে একের পর এক ট্র্যাজেডি পিছু ছাড়ছে না চট্টগ্রামের রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সওদাগর পাড়ার সংযুক্ত আরব আমিরাতফেরত মুদিদোকানি রুহুল আমিনের।

জীবনে বারবার দুর্ঘটনা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর পর আবার পড়েছেন অন্য দুর্ঘটনায়। সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার তাঁর পুরো পরিবার তছনছ করে সড়ক দুর্ঘটনায় চলে গেলেন তাঁর স্ত্রী রোজী আকতার। আহত হয়েছেন নিজে ও মেয়ে রুমা আকতার।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়ি পুড়ে যাওয়ার পর আবার নতুন পাকা বাড়ি বানিয়ে মোটামুটি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন রহুল আমিন ও তাঁর পরিবার। মেয়ের বিয়ের কথাবার্তাও শুরু হয়েছিল, তবে তা আর হলো না। পুরো পরিবারটির নতুন স্বপ্ন ছারখার হয়ে গেল আবারও।

আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা জানান, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার ছিল রুহুল আমিনের। ২০০৪ সালে তিন বছর বয়সী বড় ছেলে পুকুরে ডুবে মারা যাওয়ার পর তাঁর ট্র্যাজেডি শুরু হয়। সেই ট্র্যাজেডি চলছে এখনো।

আজ বুধবার সকালে রুহুল আমিনের নতুন বানানো পাকা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল শ খানেক নারী-পুরুষের ভিড়। লাশ জানাজা ও দাফনের জন্য নেওয়ার সময় রহুল আমিন একেকজনকে জড়িয়ে আহত শরীরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। স্বজনেরা তাঁকে বুকে টেনে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ছোট ছেলে ইমতিয়াজ হোসেন (১৫) নির্বাক। এ ঘটনায় আহত মেয়ে রুমা আক্তারের দুচোখ বেয়ে নীরবে অশ্রু ঝরছিল।

কাঁদতে কাঁদতে রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবনটাই ট্র্যাজেডিতে ভরা। একের পর এক দুর্ঘটনা আমাকে উঠে দাঁড়াতে দেয়নি। কী নির্মম ভাগ্যের পরিহাস। ছেলে হারালাম। ঘর হারালাম। এবার কেড়ে নিল ঘরের চালিকাশক্তি বাচ্চাদের মাকে। আমি এখন ঘর–সংসার কাকে দিয়ে চালাব। ছেলে–মেয়েকে কার হাত দিয়ে যাব।’