ইভাদির প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ৯৮ শতাংশই নারী

জয়তী সোসাইটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অর্চনা বিশ্বাস
ছবি: মনিরুল ইসলাম

অর্চনা বিশ্বাস এলাকায় ‘ইভাদি’ নামেই বেশি পরিচিত। ইভাদি বৌদি, ইভাদি খালাম্মা, ইভাদি আপা—যশোর শহরতলির বাসিন্দারা এসব নামেই তাঁকে ডাকেন। অর্চনা বিশ্বাসের এই পরিচিতির নেপথ্যে রয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান জয়তী সোসাইটি।

নারীদের স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখানো জয়তী সোসাইটির বর্তমান সদস্যসংখ্যা ২৮ হাজার। তাঁরা সবাই নারী। এসব নারীর মধ্যে ১ হাজার ৮০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে জয়তী সোসাইটিতে। জয়তী সোসাইটির মোট কর্মীর ৯৮ শতাংশই নারী। পুরুষ কর্মী মাত্র ২ শতাংশ।

অর্চনা বিশ্বাসের বয়স এখন ৬২ বছর। আর তাঁর জয়তী সোসাইটি ৭ নভেম্বর প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পূর্তি পালন করেছে। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে জয়তী সোসাইটির সফলভাবে এগিয়ে চলার গল্প প্রথম আলোকে শুনিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অর্চনা বিশ্বাস।

আরও পড়ুন
জয়তী হেঁশেলে খাবার পরিবেশন করছেন নারীরা
ছবি: সংগৃহীত

মুঠোফোনে অর্চনা বিশ্বাস বলেন, দাতানির্ভর হয়ে না থেকে নিজেদের আয়ে, নিজেদের ব্যবস্থাপনায় একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চেয়েছিলেন তাঁরা। এই লক্ষ্য থেকেই ২০০২ সালের ৭ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে জয়তী সোসাইটি। নারী ও শিশুদের উন্নয়নে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের ৯৮ শতাংশই নারী। তাঁরাই ক্যাশ সামলানো থেকে শুরু করে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন।

অর্চনা বিশ্বাস বলেন, জয়তী সোসাইটির বিভিন্ন ব্যবসা উদ্যোগ থেকে যে আয় হয়, তা থেকেই কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। ব্যবসা উদ্যোগ থেকে যে লাভ হয়, তা দিয়ে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে নারীরাই প্রাধান্য পাচ্ছেন।

জয়তীর ব্যবসা সামলান নারীরা

যশোরের রেলগেট মুজিব সড়কে সাড়ে সাত কাঠা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘জয়তী ভবন’। সম্প্রতি ভবনটি ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম। ভবনের ষষ্ঠতলায় জয়তীর প্রধান কার্যালয়।

ভবনটিতে রয়েছে জয়তী হেঁশেল (বাংলা রেস্টুরেন্ট), জয়তী ফাস্ট ফুড, জয়তী চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, জয়তী পিৎজা ট্রি, জয়তী বিউটি পারলার, জয়তী ফিটনেস সেন্টার, জয়তী কনফারেন্স রুম (৫টি), জয়তী কমিউনিটি সেন্টার, জয়তী কারাতে সেন্টার (নারী ও শিশুদের জন্য), জয়তী গেস্টহাউস, জয়তী স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র, জয়তী বডি ম্যাসাজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

ক্যাশ সামলানো থেকে শুরু করে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন নারীরাই
ছবি: মনিরুল ইসলাম

জয়তী সোসাইটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য—ঢেঁকিছাঁটা চাল, ভেজালমুক্ত আচার ও গুঁড়া মসলা তৈরি করে বিক্রি করছে। আছে কালোজিরা, নারিকেল, তিল, সরিষা ও বাদামের তেল। মৌসুম অনুযায়ী তারা ফুল, গুড়, আম, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে।

জয়তীর হেঁশেলটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দেয়ালে গোলাপি রং। এখানে ৮ থেকে ১০ জন নারী খাবার পরিবেশন করেন। তাঁদের পরনে গোলাপি পোশাক। হেঁশেলের ক্যাশ টেবিল সামলান নারী কর্মী। যে কেউ এই হেঁশেলে খেতে পারেন।

ভবনটির দ্বিতীয় তলায় বিউটি পারলার। এখানে কাজ করেন নারী কর্মীরা। পারলারের পাশেই নারীদের ফিটনেস সেন্টার বা ব্যায়ামাগার। ফিটনেস সেন্টার তিন শিফটে চালু থাকে। একেক শিফটে ২৫ থেকে ৩০ জন নারী একসঙ্গে ব্যায়াম করতে পারেন।

জয়তী ভবনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও সভা করার জন্য পাঁচটি বড় কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়। বিয়ে, বউভাত অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য কমিউনিটি সেন্টার আছে। আছে ৩২ কক্ষের গেস্টহাউস।

নারীদের মোটরসাইকেল চালাতে উদ্বুদ্ধ করেন অর্চনা বিশ্বাস
ছবি: সংগৃহীত

অর্চনা বিশ্বাস বলেন, জয়তী সোসাইটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। কমিটির মাধ্যমে সোসাইটি পরিচালিত হয়। সোসাইটির অধীনে যশোর শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ৫৪টি নারী সংগঠনের ৫৪টি কার্যালয় রয়েছে। এসব সংগঠনের নারীরা গ্রামের দরিদ্র ও সাধারণ নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

জয়তী সোসাইটি প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে সিইও অর্চনা বিশ্বাস বলেন, তিনিসহ ৭০ জন জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের একটি প্রকল্পে কাজ করতেন। হঠাৎ দাতা সংস্থা প্রকল্পটিতে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এত মানুষ বেকার হয়ে যাবেন, এ চিন্তা থেকে তিনি জয়তী সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। একটি মাটির চুলায় রান্না করে সোসাইটির প্রথম হেঁশেল চালু হয়।

জয়তীর নারীদের আয়ে চলে সংসার

জয়তী সোসাইটির ফিটনেস সেন্টারে জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক হিসেবে ১৯ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন কোহিনূর বেগম। ২৮ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। তখন তাঁর ছেলের বয়স ছিল মাত্র ১১ মাস। কোহিনূর বেগম বলেন, জয়তী সোসাইটির কল্যাণেই তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে জীবনসংগ্রামে টিকে আছেন।

অনার্সপড়ুয়া সামিয়া রহমান ৯ বছর ধরে সোসাইটির বিউটি পারলারের প্রধান ও রূপবিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আট বছর আগে সন্তানসহ তাঁকে রেখে চলে যান স্বামী। তার পর থেকে তিনি নিজেই মা, বাবা ও সন্তানের খরচ সামলাচ্ছেন। পাশাপাশি পড়াশোনাও করছেন।

অর্চনা বিশ্বাস ২০১৪ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে
ছবি: সংগৃহীত

হাজেরা খাতুন এক বছর ধরে জয়তী সোসাইটিতে ‘অ্যাকাউনট্যান্ট’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আগে দুই বছর তিনি জয়তী হেঁশেলের ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব সামলেছেন। এমএ পাস হাজেরা গর্ব করে বলেন, স্বামীর পাশাপাশি তিনি তাঁর আয়ের টাকা সংসারে খরচ করেন।

অর্চনার জয়িতা হয়ে ওঠা

অর্চনা বিশ্বাসের জন্ম নড়াইলে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি থিতু হন যশোরে। ২০০৮ সাল থেকে তিনি জয়তী সোসাইটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

অর্চনা বিশ্বাস বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকেই একটু অন্য রকম। নিজে মোটরসাইকেল চালানো শিখেছেন। অন্য নারীদের মোটরসাইকেল চালাতে উদ্বুদ্ধ করছেন। ২০০২ সালে যশোরে ৫৫২ জন নারীর অংশগ্রহণে ম্যারাথনের আয়োজন করে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেন।

১৯৭৬ সালে নাজিম উদ্দিনকে ভালোবেসে বিয়ে করেন অর্চনা বিশ্বাস। মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করার জন্য অর্চনা বিশ্বাসের পরিবারকে অনেক দিন একঘরে হয়ে থাকতে হয়। বিয়ের পর এই দম্পতিকে আর্থিক অনটনসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবু দমে যাননি অর্চনা বিশ্বাস।

অর্চনা বিশ্বাস বলেন, আজ তিনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, তার পেছনে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন ও ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আজাদুল কবিরের অবদান রয়েছে।

জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনে ২০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেছিলেন অর্চনা বিশ্বাস। এখন জয়তী সোসাইটিতে তাঁর বেতন লাখ টাকার বেশি। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান না হলে হয়তো বেতন আরও বেশি হতো।’

১৯৭৯ সালে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনে নারীদের সচেতন করার কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন অর্চনা বিশ্বাস। তারপর তিনি সেখানে পর্যায়ক্রমে বস্তির শিশুদের শিক্ষা কর্মসূচির শিক্ষক, সমন্বয়কারী, প্রকল্প পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে কাজ করেন।

অর্চনা বিশ্বাস বলেন, প্রতিকূল পারিবারিক ও সামাজিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে তিনি নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুল থেকে ঝরে পড়েছিলেন। চাকরি করার সময় তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। ১৯৯৬ সালে ডিপ্লোমা করতে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন।

নারী উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় গত বছর বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন নারীদের স্বনির্ভরতার পথ দেখানো অর্চনা বিশ্বাস। ২০১৪ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে। এ ছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে তিনি অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন।

অর্চনা বিশ্বাস বলেন, একান্নবর্তী পরিবারে তিনি তাঁর মাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছেন। তাঁরা সাত ভাই-বোন। তাই তাঁদের মা যাতে কম খাবার খান, এমন কথাও বলেছেন পরিবারের কোনো কোনো সদস্য। এগুলো তাঁকে ভীষণ পীড়া দিত। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার তাড়না তাঁর ভেতর খুব কাজ করত। তিনি তাঁর এই প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন। এখন অন্য নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে কাজ করছেন। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় নারীদের জন্য নানান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। প্রশিক্ষণ পাওয়া নারীদের অনেকেই এখন সফলভাবে ব্যবসা করছেন।

পথচলাটা সহজ ছিল না জানিয়ে অর্চনা বিশ্বাস বলেন, জয়তী বিভিন্ন উদ্যোগের প্রধান পদে নারীদের কাজ করার বিষয়টিকে শুরুতে অনেকে সহজভাবে নিতে পারেনি। এমনকি বিভিন্ন সময় জয়তী ভবনে হামলা পর্যন্ত হয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তাঁর দেখানো পথ ধরে এখন যশোরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীরা কাজ করছেন।

নারী-শিশুদের পাশে জয়তী

জয়তী সোসাইটির আয়ের একটি অংশ এলাকার নারী ও শিশুদের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। জয়তীর এই প্রচেষ্টায় এলাকার বিত্তবানদের অনেকেই সহযোগিতা করেন।

প্রবীণ ৪০০ মাকে তাঁদের বাড়িতে বা তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখানে প্রয়োজনীয় চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ও পোশাক সোসাইটির পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।সোসাইটির সহায়তায় যশোর শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ১২টি প্রাক্‌–প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪১২ শিশু বিনা মূল্যে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। করোনাকালে ভারতফেরত ১৩৭ নারীর কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল জয়তী ভবনে।

ভবিষ্যতে জয়তী সোসাইটির পরিসর আরও বাড়াতে চান অর্চনা বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘প্রবীণ নারীদের জন্য আমরা এমন একটা জায়গা বানাতে চাই, যেখানে তাঁরা বিনোদনসহ বিভিন্ন সেবা নিতে আসবেন।’