‘বিভাজিত রাজনীতিতে ইতিহাসচর্চা কঠিন’

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘আওয়ার ডেট টু দ্য ফোর প্রফেসরস’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) অধ্যাপক সায়মা হক, অধ্যাপক রওনক জাহান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী। প্রথম আলো কার্যালয়, ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর
ছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে দেশের জন্য কাজ করেছেন চারজন অর্থনীতিবিদ—অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তাঁদের নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে লেখা বই আওয়ার ডেট টু দ্য ফোর প্রফেসরস (চার অধ্যাপকের কাছে আমাদের ঋণ)।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটির লেখক এস নজরুল ইসলাম জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগের সাবেক গবেষণাপ্রধান। শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান বলেন, দেশের বিভাজিত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ইতিহাস চর্চা করা কঠিন।

স্বাধীনতার আগে ছয় দফা প্রণয়ন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরি, পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা এবং স্বাধীনতার পরে পরিকল্পনা কমিশনে এই চার অর্থনীতিবিদ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে এখন অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান জীবিত রয়েছেন।

বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। সূচনা বক্তব্য দেন প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক মেরিনা ইয়াসমিন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বইটির লেখক এস নজরুল ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তিনি শুধু চার অর্থনীতিবিদের সম্পর্কে একটি বই লেখেননি, তিনি ওই সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি, বিশেষ করে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে। খুব কম লোকই আছেন, যাঁরা ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করেন।’

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতে, ইতিহাস তাঁদের জীবনে কী অবদান রেখেছে, জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তা–ও দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, পাকিস্তান সরকার অর্থ জোগাড় করার জন্য অর্থনীতিবিদ এম এম আহমাদকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছে। এ অর্থ জোগাড় করা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করার জন্য। পাকিস্তানের এ উদ্যোগ রুখতে হবে। আমি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আমার পরিচিত সিনেটরদের সঙ্গে বৈঠক করি। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য বিফল হয়।’

স্বাধীনতার পরের কয়েক বছরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণার তাগিদ দেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৃণমূলের রাজনীতি করেছেন। রাজনীতিতে এখন নীতি-আদর্শ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। আগের সেই যানবাহনের তৃতীয় শ্রেণিতে ভ্রমণ, নৌকায় যাতায়াত—এসব নেই। এখন ছাত্রনেতারা এসি এসইউভি (শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি) চড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট বৈঠকে যোগ দেন। ওই ছাত্রনেতা কীভাবে বুঝবেন যে একজন রাজনীতিবিদ কীভাবে তৈরি হয়। ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে রাজনীতিবিদ তৈরি হওয়ার সুযোগ শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

ষাটের দশকের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অর্থনীতিবিদের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারেন অর্থনীতিবিদেরা। এভাবেই ষাটের দশকের রাজনৈতিক অর্থনীতির শিক্ষক থেকে আমি হয়ে গেলাম রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ।’

আলোচকেরা যা বললেন

২১টি বই ও অসংখ্য জার্নাল প্রকাশিত হওয়ার পর এস নজরুল ইসলামের সর্বশেষ বই হলো আওয়ার ডেট টু দ্য ফোর প্রফেসরস। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, চার অর্থনীতিবিদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তাঁদের কাছে বাংলাদেশের অপরিসীম ঋণ। গুণীজনদের স্বীকৃতি দিতে না পারলে কোনো জাতি এগোতে পারে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে যে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা হচ্ছিল, এই চার অর্থনীতিবিদ অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এ অঞ্চলের প্রতি অসাম্য ও অন্যায্যতা নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা যে লড়াই করেছেন, নজরুল ইসলামের বইয়ে তার প্রতিফলন উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, বঙ্গবন্ধু গাঁও-গেরামের মানুষের নেতা। তিনি গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মধ্যে থেকে সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, চার অর্থনীতিবিদের মধ্যে অধ্যাপক আনিসুর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ধ্রুপদি সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুর রহমান বলেছিলেন, সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে হলে দালান থেকে বেরিয়ে মাঠে যেতে হবে।

লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে তিনি শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক আনিসুর রহমানকে পান। অর্থনীতি যতটুকু শিখেছেন, তাঁর কাছ থেকে ওই এক বছরেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বলেন, যেকোনো বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হচ্ছে তা আরও পড়ার আগ্রহ তৈরি করে কি না। এ বইয়ের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। বইটি অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো। শেষ হয়েও যেন শেষ হয়নি। তাই এর দ্বিতীয় খণ্ড থাকা উচিত।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, এস নজরুল ইসলাম তাঁর প্রিয় বন্ধুদের একজন। সম্পাদনার সময় বইটির পাণ্ডুলিপি তিনি তিনবার পড়েছেন। বইটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ইতিহাস তুলে ধরেছে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান, বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী, দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, লেখক ফারুক মঈনুদ্দিন, মোরশেদ শফিউল হাসান, গওহার নঈম ওয়ারা, আলতাফ পারভেজ, নিশাত সুলতানা, আফসানা বেগম, বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, বিআইডিএসের গবেষণা ফেলো আনোয়ারা বেগম প্রমুখ।