প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৩ বিশিষ্টজনের চিঠি: বানীশান্তার তিন ফসলি কৃষিজমি হুকুমদখল নয়

খুলনার দাকোপ উপজেলার বানীশান্তা ইউনিয়নে কৃষিজমি রক্ষার দাবিতে নাগরিক সমাবেশ
প্রথম আলো ফাইল ছবি

খুলনার দাকোপ উপেজলার বানীশান্তায় ৩০০ একরের ফসলি জমিতে পশুর নদের ড্রেজিং করা মাটি ফেলার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন দেশের ১৩ বিশিষ্টজন। আজ বৃহস্পতিবার এক খোলা চিঠিতে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর এই হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অকৃষিজমি রয়েছে, এমন বিকল্প স্থান যেন ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলার জন্য বেছে নেওয়া হয়, প্রধানমন্ত্রীকে সেই অনুরোধ করেছেন তাঁরা। বিকল্প কিছু স্থানের নামও সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বানীশান্তা, আমতলা, ভোজনখালী, খাজুরা ও ঢাংমারী—এই পাঁচ গ্রামের হাজারের বেশি পরিবার তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য সম্পূর্ণরূপে এ কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল। এসব গ্রামের মানুষ মাটি ফেলার এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন বেশ কিছুদিন হলো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া ১৩ বিশিষ্টজনের চিঠি হুবহু তুলে ধরা হলো:

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন। সম্প্রতি মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও খুলনা জেলার দাকোপ উপজলার বানীশান্তা ইউনিয়নের হাজারেরও বেশি প্রান্তিক কৃষক পরিবারের মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থান বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ ও উত্তরণে সদয় হস্তক্ষেপ কামনায় এ খোলা চিঠি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩-এ বলেছিলেন, ‘কোনো জাতি বেশি দিন টিকতে পারে না, যদি লক্ষ লক্ষ টন খাবার ভিক্ষা করতে হয়, বিদেশ থেকে আনতে হয়...।’ এরই ধারাবাহিকতায় কৃষিজমি ও কৃষক রক্ষায় আপনি অনুশাসন দিয়েছেন যে উন্নয়ন করতে গিয়ে কৃষিজমি বিনষ্ট করা যাবে না। সকলকে কৃষিতে সম্পৃক্ত হবার আহ্বান জানিয়ে আপনি সম্প্রতি এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রেখে সেখানে একটা তরকারি গাছ বা মরিচগাছ হলেও লাগানোর তাগিদ দিয়েছেন। আপনার এসব বক্তব্য ও কৃষি ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন নীতি জনমনে আশা সঞ্চার করলেও বিভিন্ন প্রকল্পে যেভাবে কৃষিজমি গ্রাস করা হচ্ছে, তা আশঙ্কাজনক। সরকারি হিসাবমতে, প্রতিদিন দেশে কমছে ২১৯ হেক্টর আবাদি জমি। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর কৃষিজমি কমছে অর্থাৎ দেশে বর্তমান কৃষিজমি বিনষ্টের বাৎসরিক হার ১ শতাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এভাবে চলতে থাকলে দেশে কৃষিজমির সংকট আসন্ন।

দুঃখজনক হলো, কৃষিজমি ধ্বংসের এ প্রক্রিয়ায় শামিল হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। সাম্প্রতিক সময়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পশুর নদী ড্রেজিং করতে ‘মোংলা বন্দর ইনারবার ড্রেজিং’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের জন্য পশুর নদীর ড্রেজিংকৃত মাটি ফেলার জন্য ১০০০ একর জমি হুকুমদখলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার বানীশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর তিন ফসলি, উর্বর কৃষিজমি। বানীশান্তা, আমতলা, ভোজনখালী, খাজুরা ও ঢাংমারী—এ পাঁচ গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার তাঁদের জীবন ও জীবিকার জন্য সম্পূর্ণরূপে এ কৃষিজমির উপর নির্ভরশীল। বানীশান্তার কৃষিজমিকে লবণাক্ততা থেকে সুরক্ষিত রাখতে এবং কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকার বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ৩৭৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার ব্যয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ থেকে কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বাঁধ দিয়েছে বানীশান্তাসহ ৩৩ নম্বর পোল্ডারে । তারই ফলশ্রুতিতে বানীশান্তায় এখন তিন ফসল আবাদ হচ্ছে। এ কৃষিজমিতে আষাঢ় থেকে পৌষ মাসে আমন ধান, পৌষ থেকে বৈশাখ মাসে তরমুজ, বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আউশ ধান ও অন্যান্য রবিশস্য চাষ করা হয়। ফলে প্রকল্পের দোহাই দিয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ মাটি ফেলার জন্য যে জমি বেছে নিয়েছে, তা সরকারের অন্য ঋণ প্রকল্পের আওতায় সুরক্ষিত করা কৃষিজমি এবং প্রান্তিক মানুষের একমাত্র অবলম্বন। এ জমিতে ড্রেজিং-এর মাটি ফেললে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হবে হাজারের বেশি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সনাতনী ধর্মের পরিবার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
২০২২ সালের শুরুতে খুলনা জেলা প্রশাসন কর্তৃক বানীশান্তা এলাকার ২৫০ জন কৃষিজমির মালিককে হুকুমদখলের নোটিশ প্রদান করার প্রক্রিয়া শুরু হলে এলাকার কৃষিজমির মালিকেরাসহ অন্য কিষান-কিষানিরা আপত্তি জানিয়ে জেলা প্রশাসককে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। তারও আগে জেলা প্রশাসনের নির্দেশে তদন্ত করে ২৪ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে বানীশান্তা ইউনিয়ন ভূমি অফিস জানিয়ে দেয় যে বানীশান্তায় মাটি ভরাট করা হলে সেখানে জনরোষের আশঙ্কা রয়েছে। কিষান-কিষানির সকল অভিযোগ ও মতামত উপেক্ষা করে বানীশান্তার ৩০০ একর কৃষিজমি হুকুমদখলের প্রক্রিয়া শেষ করে খুলনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক। ফলে জনমত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া এমনকি জনরোষ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা–সংক্রান্ত জেলা প্রসাশনের নিজস্ব প্রতিবেদনও প্রহসনে পরিণত হলো।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার আগে ২০১৮ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য বানীশান্তার মাটি নিচু জমি এবং তা জোয়ারের সময় প্লাবিত হয়ে স্থানীয় জনসাধারণের ক্ষতি করে আসছে। ড্রেজিংকৃত মাটি ফেললে জমির মান বাড়বে, তা ফসলের জন্য উপকারী হবে এবং জনবসতি আর প্লাবিত হবে না; বানীশান্তার মানুষ নদীভাঙনের আশঙ্কামুক্ত হবে। ড্রেজিংকৃত মাটি ৩-৪ কি.মি.-এর মধ্যেই ফেলতে হবে এবং সে জন্য বানীশান্তাই একমাত্র স্থান, এর কোনো বিকল্প নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষের মতে আন্দোলনকারীরা ‘কুচক্রী মহল’ এবং যেহেতু ক্ষতিপূরণের ৭ কোটি টাকা জেলা প্রশাসন বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে, তাই বানীশান্তায় মাটি ফেলতে কোনো বাধা নেই। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ২২ আগস্ট, ২০২২ তারিখে এক সংবাদ সম্মেলন করে ‘একটি মহলের’ বিরুদ্ধে ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্প বন্ধের পাঁয়তারার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যারা ভুল বুঝিয়ে তিন ফসলি জমি উল্লেখ করে ড্রেজিং করা বালু ও মাটি ফেলতে বাধা দিচ্ছেন । ‘ষড়যন্ত্রকারী’ এ মহলকে চিহ্নিত করে ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগের কথাও তিনি জানিয়েছেন।

ড্রেজিংকৃত মাটিতে যে কোন ফসল হবে না, তা বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১১ এবং ২০২১-২০২২ সালে চিলাতে ফেলা ড্রেজিং–এর মাটির স্তূপ থেকেই স্পষ্ট। সেখানে এত বছরে এমনকি আগাছারও জন্ম হয়নি। ড্রেজিংয়ের মাটি ৩ কিলোমিটারের মধ্যেই ফেলতে হবে, বন্দর কর্তৃপক্ষের এমন দাবি অসাড়। বর্তমানে চট্টগ্রাম এবং পায়রা বন্দরে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা দিয়ে ড্রেজিংয়ের মাটি অনেক দূরে ফেলা সম্ভব। অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোংলা বন্দর রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় এসব যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ও ব্যবহারে সরকার পিছপা হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।

এলাকাবাসী ও কৃষক, এলাকার বর্তমান দুজন স্থানীয় সংসদ সদস্য, প্রাক্তন সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ এবং স্থানীয় জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃবৃন্দের কেউই পশুর নদী ড্রেজিংয়ের বিপক্ষে নয়। তাদের একটাই দাবি, বানীশান্তার ৩০০ একর তিন ফসলি জমির বদলে ড্রেজিংয়ের মাটি বিকল্প জায়গায় ফেলা হোক। বিকল্প জায়গা হিসেবে তারা মোংলার কাইনমারি মৌজা, খানজাহান আলী বিমানবন্দরের প্রস্তাবিত এলাকা, খুলনা-মোংলা ছয়-লেনের প্রস্তাবিত রাস্তা, প্রস্তাবিত ইপিজেড এলাকা, জয়মনি চিলা যেখানে মাটি ফেলা হয়েছে সেই এলাকা প্রস্তাব করেছে। উল্লেখ্য, এখানে ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলা হলে এসব এলাকায় মাটি ভরাট বাবদ সরকারের বিরাট অঙ্কের টাকাটা বেঁচে যাবে।

জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নয়, তাদের যৌক্তিক দাবিকে মেনে নিয়েই ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলার সংকটকে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এলাকার জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসক, আন্দোলনরত কৃষাণ-কৃষাণী এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়ে অকৃষিজমি রয়েছে এমন বিকল্প স্থান যেন ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলার জন্য বেছে নেয়া হয় আমরা সে বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, আপনার হস্তক্ষেপ, পরামর্শ ও আন্তরিকতায় বানীশান্তার কৃষিজমি সুরক্ষিত রেখেই মোংলা বন্দরের উন্নয়ন সম্ভব হবে এবং আপনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে।

সুলতানা কামাল, মানবাধিকারকর্মী ও সভাপতি, বাপা
খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি
রাশেদা কে চৌধূরী, শিক্ষাকর্মী
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন
শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি
সারা হোসেন, আইনজীবী ও অবৈতনিক পরিচালক, ব্লাস্ট
জেড আই খান পান্না, আইনজীবী ও সভাপতি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
আসিফ সালেহ, নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক
মণীন্দ্র কুমার নাথ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
কাজল দেবনাথ, উপদেষ্টা, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন জাতীয় নাগরিক সমন্বয় সেল
হাসান মেহেদী, প্রধান নির্বাহী, ক্লিন
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা