দেশের বড় সমস্যা কী কী, উঠে এল জরিপে

দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এই জরিপ করেছে

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভুল পথে যাচ্ছে বলে মনে করেন আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ। অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষ বলেছেন, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

দেশের মানুষের এই মতামত উঠে এসেছে দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে। এতে বলা হয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশের ভুল পথে যাওয়ার কথা বলেছেন প্রায় ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা। আর নিজেদের জীবনে দ্রব্যমূল্যের আঘাত মারাত্মকভাবে পড়ার কথা বলেছেন ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা।

এই জরিপে বর্তমানে দেশের প্রধান সমস্যাগুলো কী কী, তা নিয়ে মানুষের মতামত উঠে এসেছে।

জরিপটি আজ মঙ্গলবার এশিয়া ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। দেশের ৬৪ জেলার ১০ হাজার ২৪০ জন মানুষের ওপর করা এই জরিপে তথ্য নেওয়া হয় গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি সময়ে। প্রতিটি জেলা থেকে ১৬০ জন উত্তরদাতা নেওয়া হয়েছে। উত্তরদাতাদের মধ্যে অর্ধেক ছিলেন নারী।

এশিয়া ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অলাভজনক উন্নয়ন সংস্থা। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে এটি সুশাসন, নারীর ক্ষমতা, জেন্ডার বৈষম্য দূর করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে। অন্যদিকে বিআইজিডি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা সংস্থা।

দুই সংস্থার জরিপ ‘দ্য স্টেট অব বাংলাদেশ’স পলিটিক্যাল, গভর্ন্যান্স, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটি: অ্যাকোর্ডিং টু ইটস সিটিজেনস’ (বাংলাদেশের রাজনৈতিক, শাসন, উন্নয়ন ও সামাজিক পরিস্থিতি: নাগরিকদের মত) ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও করা হয়।

জরিপে একটি প্রশ্ন ছিল এমন, আপনি কি মনে করেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে। জবাবে ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বাংলাদেশ ভুল পথে যাচ্ছে। ২৫ শতাংশের মত হলো, বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে। আর ৪ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে জানেন না। ১ শতাংশ উত্তরদাতা উত্তর দেননি।

এই প্রশ্নে ২০১৯ সালের জরিপে কী উত্তর এসেছিল, তা–ও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। দেখা যায়, ওই বছরের জরিপে ৭০ শতাংশের কিছু বেশি উত্তরদাতা বলেছিলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে। তখন ২৮ শতাংশ ভুল পথে যাওয়ার কথা বলেছিলেন।

উল্লেখ্য, যাঁদের আয় কম, সেই সব উত্তরদাতার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেশ ভুল পথে যাওয়ার মতামত বেশি এসেছে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক নিয়েও জরিপে উত্তরদাতাদের মতামত নেওয়া হয়। সাড়ে ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভুল পথে যাচ্ছে, হারটি ২০১৯ সালে ছিল প্রায় ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে। ২০১৯ সালে হারটি ছিল প্রায় ৬৪ শতাংশ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভুল পথে যাচ্ছে, এমন মতামত দিয়েছেন আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ।

২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, সামাজিক দিক দিয়ে সঠিক পথে রয়েছে বলে মনে করেন ৭৭ শতাংশ মানুষ। ২০২২ সালে হারটি কমে নেমেছে সাড়ে ৫৭ শতাংশে। সামাজিক দিক দিয়ে দেশ ভুল পথে যাচ্ছে বলে মনে করেন প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ, এটা ২০১৯ সালে ছিল প্রায় ২২ শতাংশ।

দেশের বড় সমস্যা

দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো কী কী—এই প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ সামনে এনেছেন নিত্যপণ্যের দামকে। এরপর রয়েছে অর্থনীতি অথবা ব্যবসার মন্দা, বেকারত্ব অথবা জীবিকার সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা অসহিষ্ণুতা, দুর্নীতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি।

নিত্যপণ্যের দামকে ৪৪ শতাংশ মানুষ সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা ২০১৯ সালে ছিল ৩৩ শতাংশ। অর্থনীতি অথবা ব্যবসার মন্দা সামনে এসেছে ১১ শতাংশের উত্তরে, যেটা ২০১৯ সালে ছিল ৫ শতাংশ। বেকারত্ব অথবা জীবিকার সমস্যা সামনে এনেছেন ১০ শতাংশ মানুষ, যেটা ২০১৯ সালে ছিল ১৮ শতাংশ। দুর্নীতিকে সামনে এনেছেন ৩ শতাংশ মানুষ, যা ২০১৯ সালে ছিল ১১ শতাংশ।
১৮ শতাংশ অন্যান্য সমস্যাকে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ৪ শতাংশ উত্তরদাতা প্রশ্নটির উত্তর জানেন না বলে জানিয়েছেন।

দ্রব্যমূল্য

জরিপে প্রশ্ন ছিল, সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কি আপনার জীবনে আঘাত হেনেছে। উত্তরে ৮৪ শতাংশ বলেছেন, আঘাত ছিল মারাত্মক। ১৩ শতাংশের উত্তর ছিল, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে আঘাত পেয়েছেন।

দ্রব্যমূল্যের কারণে আঘাত না পাওয়া মানুষের হার খুবই কম। যেমন খুব একটা আঘাত পাননি বলে জানিয়েছেন মাত্র ১ শতাংশ উত্তরদাতা। আর ২ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা মোটেও আঘাত পাননি।

এক দলের কর্তৃত্ব

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দলের কর্তৃত্ব দেখা যায়—এই মতের সঙ্গে শক্তভাবে ও মোটামুটিভাবে একমত পোষণ করেছেন ৭২ শতাংশ উত্তরদাতা। হারটি ২০১৯ সালে ৮৬ শতাংশ ছিল।

রাজনীতিতে প্রভাবশালী দলটির ভূমিকা নেতিবাচক মনে করেন ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা, যা ২০১৯ সালে ছিল ৩৮ শতাংশ। দলটির ভূমিকা ইতিবাচক বলে মনে করেন ৩৬ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৫৯ শতাংশ।

সমসাময়িক বিষয়

জরিপে উঠে আসে, রোহিঙ্গাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি কমে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ মানুষ রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ইতিবাচক মতামত দিয়েছিলেন, যা ২০২২ সালে কমে ১৩ শতাংশে নেমেছে। ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য যথেষ্ট করেছে ও করছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ (৭২ শতাংশ) বলেছেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। সেতু নির্মাণের কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় অর্ধেক মানুষ (৪৭ শতাংশ)। ২৮ শতাংশ মানুষ কৃতিত্ব দিয়েছেন সরকারকে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে কৃতিত্ব দিয়েছেন ১ শতাংশ করে উত্তরদাতা।

‘এখনো উন্নতি হয়নি’

মানুষের জীবনে দ্রব্যমূল্যের প্রভাব নিয়ে সাম্প্রতিককালে আরও কয়েকটি জরিপ হয়েছে। যেমন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপে গত অক্টোবরে বলা হয়, ৬৪ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। খাবার কেনার জন্য কেউ কেউ পরিবারের কোনো সম্পদ বিক্রি করছেন। কেউ কেউ ঋণ করছেন।

বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি দিয়ে এশিয়া ফাউন্ডেশন ও বিআইজিডির জরিপে যা উঠে এসেছে, তার সঙ্গে দ্বিমত করার উপায় নেই। সানেমের জরিপেও একই চিত্র উঠে এসেছিল। তিনি আরও বলেন, নতুন জরিপ যে সময়ে হয়েছে (গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি), সে সময় অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নগামী ছিল। ফলে মানুষের এই ধারণা হওয়া স্বাভাবিক।

অর্থনীতি ও মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি উল্লেখ করে সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘এখনো আমি মনে করি উদ্বেগের জায়গায় উন্নতি হয়নি।’