পদ্মা সেতুতে ৪০০ কোটি টাকার টোল আদায় কি যথেষ্ট হলো

পদ্মা সেতু চালুর পর ৬ মাসে টোল থেকে আয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার মতো
ছবি: ফাইল ছবি

পদ্মা সেতু চালুর ছয় মাস পেরিয়েছে। ঢাকা থেকে বরিশালসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার যাতায়াতের সময় অনেক কমে এসেছে। এসব এলাকায় ব্যবসা ও শিল্পের প্রসারও শুরু হয়েছে। সেতু চালুর পর এ পর্যন্ত সরকার টোল বাবদ ৪০০ কোটি টাকার কিছু বেশি আয় করেছে। অর্থাৎ পদ্মা সেতু যাতায়াত সহজ করেছে, সরকার আয়ও করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পদ্মা সেতুতে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা তুলে আনার জন্য প্রত্যাশিত আয় হচ্ছে কি না। সেতু নির্মাণের আগে যানবাহন চলাচল ও টোল আদায়ের যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, এর কতটা মিলছে?

গত বছর ২৫ জুন পদ্মা সেতুর চলাচল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পর দিন থেকে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল শুরু হয়। সেতুটি ২০১৪ সালে চালু হবে ধরে নিয়ে এর নকশা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত পরামর্শকেরা সেতু দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা ও টোলের হার নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। সেতুটি দিয়ে ২০১৪ সাল থেকে পরবর্তী ৩৫ বছরে প্রতিদিন কী পরিমাণ যানবাহন চলাচল করবে, তার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। এতে টোল বাবদ বছরে কত আয় হতে পারে, এরও ধারণা দেওয়া হয়।

কিন্তু সেতু চালু হয়েছে আট বছর পর, ২০২২ সালে। পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২২ সালে প্রতিদিন পদ্মা সেতু দিয়ে দৈনিক ২৩ হাজার ৯৫৪টি যানবাহন চলাচল করার কথা। ২০২৯ সালে তা হবে দৈনিক ৩৪ হাজার ৭২৫। ২০৫০ সালে এই সেতু দিয়ে দৈনিক যানবাহন চলাচল করবে ৬৬ হাজার ৮২৯টি।

২০২২ সালে সেতু থেকে টোল বাবদ ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা আয় করার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ২০২৯ সালে আয় হওয়ার কথা ১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। আর ২০৫০ সালে এই সেতু থেকে ৩ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা আয় হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

পূর্বাভাসের চেয়ে যানবাহন চলাচল ও আয় কম

সেতু বিভাগের হিসাবে, চালুর পর পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৪ হাজার ৭১৮টি করে যানবাহন পারাপার হয়েছে। ছয় মাসে টোল থেকে আয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার মতো। প্রতিদিন গড়ে টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি সাড়ে ১২ লাখ টাকার মতো করে। সে হিসাবে বছর শেষে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার টোল আদায় হতে পারে। অর্থাৎ পূর্বাভাসের চেয়ে প্রতিদিন ৯ হাজারের মতো যানবাহন কম চলেছে। বছর শেষে আয়ও পূর্বাভাসের চেয়ে ৫০০ কোটি টাকার মতো কম।

সেতু বিভাগের সূত্র বলছে, দৈনিক যানবাহন চলাচলের সংখ্যা পূর্বাভাস থেকে বেশি হওয়ার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চলাচল করার সুযোগ দিতে হবে। যেমন, চালুর প্রথম দিন ৫১ হাজার ৩১৬টি যানবাহন চলাচল করেছে। ওই দিন টোল আদায় হয় দুই কোটি ৯ লাখ টাকা। সরকার দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সেতু চালুর দুদিন পরই মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেয়। মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের পরদিন যানবাহন চলাচল দাঁড়ায় ২৩ হাজারের কম। এরপর প্রতিদিনই যানবাহন চলাচলের হার কমেছে। তবে যানবাহন চলাচল কমলেও টোল আদায়ের হার কমেনি।

সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল চলতে দিলে দিনে অন্তত ১০ হাজার যানবাহন বেড়ে যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে আয় বাড়বে ১০ লাখ টাকা। কিন্তু মোটরসাইকেল বন্ধের পর বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন বেড়েছে। এসব যানের টোল হার বেশি বলে আয় কমেনি। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ভবিষ্যতে বাস-ট্রাকসহ বড় যানের সংখ্যা আরও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে আয় লক্ষ্যমাত্রা মেনে হয়তো অর্জন করা যাবে।

আয় কম হওয়ার প্রভাব

পদ্মা সেতুর পূর্বাভাস মতো আয় না হলে কী সমস্যা? এই প্রশ্ন আসতেই পারে। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলেও এই টাকা ঋণ হিসেবে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে। এটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। নিজের আয়ে চলতে হয়। পদ্মা সেতুর মতো বঙ্গবন্ধু ও মুক্তারপুর সেতু এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলও এই প্রতিষ্ঠানের অধীন।

বঙ্গবন্ধু সেতু বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের ঋণে নির্মিত হয়েছে। সেতুর টোল থেকে এই ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করা হচ্ছে। ২০৩৪ সাল থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। একইভাবে টানেল নির্মাণের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে চীনকে। পদ্মা সেতুর ঋণের টাকা কখন, কীভাবে পরিশোধ করতে হবে, এই বিষয়ে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিও আছে সেতু কর্তৃপক্ষের।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় যে টাকা বিনিয়োগ করেছে, এর বেশির ভাগই চীনা ঠিকাদারকে ডলারে রূপান্তরিত করে বিল দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সরকার টাকাকে ডলারে রূপান্তর করে বিনিয়োগ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় অবশ্য সেতু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকাই নেবে। এ লক্ষ্যে ২০১৯ সালে সেতু বিভাগের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চুক্তি সই হয়েছে। তখন অবশ্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। কিন্তু এর মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। ফলে এই চুক্তিতে কিছুটা সংশোধন আনতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, ৩৫ বছরে ঋণের টাকা ১ শতাংশ হারে সুদসহ ফেরত দিতে হবে।

এ জন্য তিন মাস পরপর কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে ১৪০ কিস্তিতে ঋণের টাকা (সুদ ও আসলে) পরিশোধ করা হবে। কোন বছর কত টাকা ফেরত দিতে হবে, এর একটা রূপরেখাও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। সেতু চালুর পর প্রথম বছরের কিস্তি ৫৯৬ কোটি টাকা। দশম বছরে গিয়ে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ১৬তম বছরে গিয়ে কিস্তির পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ৩৫ তম বছরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

টোল কি যথেষ্ট হচ্ছে

সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যানবাহনের চলাচল ও টোল থেকে আয় ভালোই হচ্ছে। দিন দিন সেটা বাড়বে। ফলে বিনিয়োগের টাকা সময় মতোই উঠে আসবে বলে তিনি মনে করেন।

আরও পড়ুন

পদ্মা সেতু দিয়ে ভবিষ্যতে রেল চলবে। এর জন্য রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টোল পাওয়া যাবে। সেতু দিয়ে গ্যাস-ফাইবার অপটিকসহ সেবা সংস্থার লাইন পরিবহন বাবদ টোল পাওয়া যাবে। সেতুর ভাটি দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের যে লাইন গেছে, সেটিতেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিনিয়োগ আছে। এর জন্যও টোল পাওয়া যাবে। এসব টোল থেকে কত আয় হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি।

রেল ও সেবা সংস্থার টোলের বিষয়ে মো. মনজুর হোসেন বলেন, এসব বিষয়ে আলোচনা চলছে। রেল কিংবা বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেটাকে ব্যয়–সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নিজেদের হিসাবে নিতে পারে। এতে সেতু বিভাগের দায় কমে যাবে। তাদের কাছ থেকে টোল হিসেবে অর্থও নেওয়া হতে পারে। গ্যাস বা অন্যান্য সেবার জন্য বাৎসরিক টোল নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে প্রকল্প নেওয়ার সময় একটু বাড়িয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়। এতে সহজে প্রকল্প লাভজনক হিসেবে দেখিয়ে পাস করা যায়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও সেটা হতে পারে। তবে এখন যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করছে এবং টোল আদায় হচ্ছে তা ঠিকই আছে। বরং পূর্বাভাস বাড়িয়ে ধরা হয়েছে বলে মনে হয়েছে।

আরও পড়ুন

অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার সময় দুই পারে ভালো সড়ক ছিল না। আস্তে আস্তে মহাসড়ক হয়েছে, যানবাহন বেড়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে চালু করা হয়েছে। ফলে এ সেতু ঘিরে প্রস্তুতি ভালো ছিল। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের তোড়জোড় না হলে খুব তাড়াতাড়ি যানবাহনের চলাচল পূর্বাভাস মেনে বাড়বে না।

পূর্বাভাস অনুযায়ী মুনাফা ২০২৯ সালে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, টোল থেকে আয় করা টাকা থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট চলে যাবে সরকারের ঘরে। এরপর টোল আদায়ের জন্য যে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের পেছনে ব্যয় করতে হবে। ৫ বছরের জন্য কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়েকে ৬৯৩ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এর বাইরে নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে ব্যয় করতে হবে। এরপর যে টাকা থাকবে, তা থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে।

এসব খরচের পর টাকা থাকলে তা সেতু কর্তৃপক্ষের মুনাফা হিসেবে গণ্য হবে। তবে এই মুনাফা থেকে আবার সরকারকে ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে।

সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, পূর্বাভাস অনুসারে আয় হলে ২০২৯ সালে গিয়ে সব ব্যয় মিটিয়ে মুনাফা করতে থাকবে সেতু বিভাগ। ২০৫০ সাল নাগাদ পদ্মা সেতু থেকে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা মুনাফা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে মুনাফা পেতেও বেশি সময় লাগবে।

আরও পড়ুন

প্রতি ১৫ বছর পরপর টোল হার ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সে হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ একটি প্রাইভেট কারের টোল ২ হাজার টাকার বেশি হবে। এখন যা ৭৫০ টাকা।

প্রতি ১০ বছর পরপর সেতুর বড় ধরনের মেরামত করতে হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চালুর দশম বছরে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। ২০তম বছরে ব্যয় করতে হবে এক হাজার কোটি টাকা। ৩০তম ও ৪০তম বছরে ব্যয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকা করে।

প্রতি বছর বিনিয়োগের অবচয় হবে মোট নির্মাণব্যয়ের ২ শতাংশ হারে।