উপকূলের ১৯ জেলায় ডেঙ্গু বেশি
দেশের উপকূলের জেলাগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। এসব জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯০ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৩৪৯ জন। কেন উপকূলের জেলাগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যু তুলনামূলক বেশি, তার কারণ জানা যাচ্ছে না।
তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণ এসব জেলায় ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা দুর্বল।
বিজ্ঞানীরা এক দশকের বেশি সময় ধরে বলে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কীটপতঙ্গবাহিত রোগ বাড়বে। যেসব রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া অন্যতম। এই দুটি রোগ এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ইমেরিটাস বিজ্ঞানী পিটার কিম স্ট্রিডফিল্ড প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষাকাল দীর্ঘ হওয়ার ঝুঁকি আছে। এসব পরিবর্তনের কারণে কিছু রোগের ঝুঁকি বাড়বে। তিনি বলেন, উপকূলের জেলাগুলোতে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ (বুধবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত) হিসাবে সারা দেশে ১ হাজার ৪২৯ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর মারা গেছেন ৮ জন। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৯৮ হাজার ৯৪। সারা দেশে মারা গেছেন ১ হাজার ৫২৮ জন।
ঢাকার বাইরে কী হচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না। শহরগুলোতে ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস ইজিপটাই, আর গ্রামে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটায় এডিস অ্যালবোপিকটাস। বাস্তবে কী ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
উপকূলের পরিস্থিতি
দুই দশকের বেশি সময় ধরে বলা হচ্ছে, উপকূলের ১৯টি জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি পড়বে। এই তালিকায় আছে বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, যশোর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ।
কন্ট্রোল রুমের হিসাবে, ঢাকা শহরের বাইরে ৬৪ জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৯৩ হাজার ২১৬ জন। এর মধ্যে উপকূলের ১৯ জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯০ হাজার ৫৮৬ জন। অর্থাৎ ঢাকা শহরের বাইরের আক্রান্তের ৪৭ শতাংশই এসব জেলার মানুষ।
পাশাপাশি ডেঙ্গুতে তুলনামূলকভাবে মৃত্যুও এসব জেলায় বেশি। ঢাকা শহরের বাইরে ৬৪ জেলায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৬৩৮ জন। এর মধ্যে উপকূলের জেলাগুলোতে মারা গেছেন ৩৪৯ জন। অর্থাৎ ঢাকা শহরের বাইরের ৫৫ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে এ কয়টি জেলায়।
সরকারি পরিসংখ্যানে এটা স্পষ্ট যে উপকূলের জেলাগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি। এর কারণ কী, এর সঙ্গে কি জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক আছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ঠিক কী কারণে উপকূলের জেলাগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি, তার সঠিক উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না। তবে অনুসন্ধান করলে নিশ্চয়ই উত্তর পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, গড় তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বাতাসের আর্দ্রতা যদি এডিস মশার জীবনের অনুকূলে থাকে, তা হলে ডেঙ্গু বাড়ে। অন্যদিকে মানুষের চলাচলের সঙ্গে ডেঙ্গু সংক্রমণের সম্পর্ক আছে। আবার মানুষের অভ্যাসের কারণেও ডেঙ্গু বাড়তে বা কমতে পারে।
উপকূলের এই জেলাগুলোতে মশার ঘনত্ব বেশি কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এডিস মশা বেশি থাকলে ডেঙ্গু বেশি ছড়াবেই। জেলাগুলোতে এডিস ইজিপটাই নাকি এডিস অ্যালবোপিকটাসে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তা-ও জানা দরকার।জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন
নজর নেই
ঢাকা শহরের বাইরে ডেঙ্গু নিয়ে নীতিনির্ধারকদের আগ্রহ কম দেখা যায়। মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড মূলত ঢাকা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে ডেঙ্গু মোকাবিলা নিয়ে সভা-সেমিনার-আলোচনাও মূলত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক হতে দেখা যায়। অথচ মোট আক্রান্তের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ঢাকা শহরের বাইরে।
২৭ আগস্ট রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ডেঙ্গুবিষয়ক একটি আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেছিলেন, ঢাকার বাইরে কী হচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না। শহরগুলোতে ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস ইজিপটাই, আর গ্রামে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটায় এডিস অ্যালবোপিকটাস। বাস্তবে কী ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
এদিকে আইসিডিডিআরবি সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বরিশাল এলাকায় ডায়রিয়াজনিত রোগ বেড়েছে। ডায়রিয়াজনিত রোগ বৃদ্ধির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে বলে বিজ্ঞানীদের একটি মহল দাবি করে।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উপকূলের এই জেলাগুলোতে মশার ঘনত্ব বেশি কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এডিস মশা বেশি থাকলে ডেঙ্গু বেশি ছড়াবেই। জেলাগুলোতে এডিস ইজিপটাই নাকি এডিস অ্যালবোপিকটাসে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তা-ও জানা দরকার। তবে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণ এসব জেলায় ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা দুর্বল, এটা নিশ্চিত বলা যায়।