একজিমার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত রোববার অনুষ্ঠিত হয়

একজিমা কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। অনেকেই এটিকে ছোঁয়াচে রোগ ভেবে একজিমায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এড়িয়ে চলেন। যা রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও গুরুতর প্রভাব ফেলে।

এসকেএফ ডার্মাটোলজির উদ্যোগে ‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. ফারজানা সুলতানা নূর। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার সুরাইয়া আহমেদ।

একজিমার সমস্যা নিয়ে অনেকেই ঝামেলায় থাকেন এবং এর চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও সতর্কতার অভাব। তাই আলোচনার এ পর্বে একজিমা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন ডা. ফারজানা সুলতানা। পর্বটি গত রোববার সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

আলোচনার শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান, একজিমা বা অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস বলতে কী বোঝায় এবং এর প্রধান লক্ষণগুলো কী?

উত্তরে ডা. ফারজানা সুলতানা বলেন, এটি এক ধরনের চর্মরোগ। এর প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র চুলকানি। এ ছাড়া চুলকানির সঙ্গে ত্বকে লালচে দানা বা র‍্যাশ দেখা দেয়, ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং নখে কখনো কখনো সংক্রমণ বা পুঁজও তৈরি হতে পারে।

একজিমা কেন হয়

ডা. ফারজানা সুলতানা জানান, একজিমা একটি বংশগত রোগ। যদি বাবা-মা, দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির মধ্যে কারও অ্যাজমা, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, হে ফিভার বা আর্টিকেরিয়া (আমবাত) থাকে, তবে সন্তানের একজিমা হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। বিশেষ করে, যদি বাবা-মা দুজনেরই এই ধরনের সমস্যা থাকে, ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পায়।

একজিমা কোনো ছোঁয়াচে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না। ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগ, যার প্রভাবে ত্বকের প্রতিরক্ষা স্তর বা স্কিন ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যায়, ফলে ত্বকে অ্যালার্জেন, ধুলাবালি কিংবা জীবাণু সহজে প্রবেশ করতে পারে।

একজিমা সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এ বিষয়ে ডা. ফারজানা সুলতানা বলেন, কারণ শিশুদের ত্বক খুব নরম ও কোমল থাকে এবং পরিবারে কারও এই রোগ থাকলেও শিশুদের মধ্যে এটি খুব সহজে ছড়ায়। শিশুদের ত্বকের প্রতিরক্ষা স্তর বা স্কিন ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যায়। যদি বয়স বাড়ার সঙ্গে এটি পুরোপুরি ভালো না হয়, তবে এটি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়ও (অ্যাডাল্ট একজিমা) থাকতে পারে।

ত্বককে সুস্থ রাখতে একজিমা প্রতিরোধে জনসচেতনতা এবং আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন ডা. ফারজানা সুলতানা নূর
ছবি: প্রথম আলো

শিশুদের একজিমা কি শরীরের কোনো বিশেষ অংশে হয় নাকি যেকোনো জায়গায় হতে পারে? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. ফারজানা সুলতানা বলেন, ‘একজিমা সাধারণত শিশুদের গালে, গলায়, ঘাড়ে, হাতে, পায়ে এবং মাথায় দেখা যায়। গালে প্রথমে ত্বক লাল হয়, গুটিগুটি দানা ওঠে এবং তীব্র চুলকানি থাকে। পরবর্তীতে ত্বক শুষ্ক ও মোটা হয়ে যায়। কখনো কখনো ত্বক থেকে রস বা পুঁজ পড়তেও পারে। কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে একজিমা তাদের গলার ভাঁজ, কনুই, হাঁটু বা পায়ের ভাঁজ ইত্যাদি ভাঁজযুক্ত অংশে বেশি দেখা যায়।

আবহাওয়ার সঙ্গে কী একজিমার সম্পর্কের বিষয়ে ডা. ফারজানা বলেন, একজিমা শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল উভয় সময়েই হতে পারে। শীতকালে ত্বক শুষ্ক হওয়ায় চুলকানি বাড়তে থাকে এবং একজিমা আরও তীব্র হয়। আর গরমকালে অতিরিক্ত ঘামের কারণে চুলকানি বেড়ে যায়, যা রোগের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।’

পোষা প্রাণী থেকে একজিমা ছড়াতে বা বাড়তে পারে কি না? জানতে চাইলে, ডা. ফারজানা সুলতানা নূর বলেন, পোষা প্রাণী যেমন বিড়াল, কুকুর, কবুতর, পাখি থেকে একজিমা সরাসরি ছড়ায় না, তবে এসব প্রাণীর ডাস্ট বা ত্বকের আঁশ একজিমাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই পরিবারে একজিমা রোগী থাকলে পোষা প্রাণী পরিহার করা ভালো।

করণীয় কী

কখন একজন একজিমা আক্রান্ত রোগীর ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. ফারজানা বলেন, একজিমা রোগীদের প্রথম কাজ হলো ত্বককে সব সময় ময়েশ্চারাইজার অর্থাৎ নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, ভেসলিন, লোশন ইত্যাদি দিয়ে আর্দ্র রাখা। এরপরও যদি রোগ বাড়তে থাকে বা নিয়ন্ত্রণে না আসে, তবে শুরুতেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি বা সেলফ-মেডিকেশন এড়িয়ে চলতে হবে।

চিকিৎসা ছাড়াও একজিমা আক্রান্ত রোগীকে আর কী কী সতর্কতা বা নিয়ম মেনে চলতে হয়? এ বিষয়ে ডা. ফারজানা সুলতানা নূর বলেন, খেয়াল রাখতে হবে যেন অতিরিক্ত ঘাম না হয়। ঢিলেঢালা সুতির পোশাক পরিধান করতে হবে এবং সিনথেটিক বা জরি-চুমকির কাজ করা পোশাক এড়িয়ে চলতে হবে। এ ছাড়া শিশুরা যখন বাইরে খেলাধুলা করবে, তখন তাঁদের ফুল হাতা জামা-পায়জামা পরানো উচিত।

তিনি আরও বলেন, একজিমা রোগীদের কম পরিমাণে সাবান, শ্যাম্পু ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা উচিত। প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একজিমা রোগীদের কোনো প্রসাধনী ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সতর্কতা জরুরি

ডায়াবেটিসের মতো রোগের সঙ্গে একজিমার কোনো সম্পর্ক আছে কি না? উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. ফারজানা বলেন, যখন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন ত্বকে সংক্রমণ বাড়ে এবং একজিমা আরও তীব্র হয়। এই সময় স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করলে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে, তাই চিকিৎসায় অতিরিক্ত সতর্কতা জরুরি।

একজিমার আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে ডা. ফারজানা সুলতানা নূর বলেন, এখন একজিমার সাধারণ চিকিৎসা যেমন স্টেরয়েড ক্রিম এবং ময়েশ্চারাইজারের পাশাপাশি আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতিও ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ যেমন সাইক্লোস্পোরিন এবং জ্যাক ইনহিবিটর, তবে জ্যাক ইনহিবিটর কিছুটা ব্যয়বহুল।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে ডা. ফারজানা সুলতানা নূর বলেন, একজিমা আক্রান্ত ব্যক্তি বিশেষ করে শিশুরা, নিজেদের ত্বকে র‍্যাশ থাকায় লজ্জা বা বিষণ্নতায় ভুগতে পারে এবং অন্যরা এটিকে ছোঁয়াচে রোগ মনে করে তাদের এড়িয়ে চলতে পারে। তাই পরিবার এবং রোগীকে সঠিকভাবে কাউন্সেলিং করা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বোঝাতে হবে, একজিমা ছোঁয়াচে রোগ নয় এবং মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা কমালে রোগটি আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।