ডিম্বাশয় ক্যানসার: প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে বেঁচে থাকার হার ৮৮ শতাংশ

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত হয়

কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলেই ডিম্বাশয়ে ক্যানসার সৃষ্টি হয়। পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের মধ্যেই এই ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প বয়সী নারীদেরও ডিম্বাশয়ের ক্যানসার হতে পারে। এই ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে রোগীর বেঁচে থাকার হার ৮৮ শতাংশ।

ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে এসকেএফ অনকোলজির নিয়মিত আয়োজন ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে। অনুষ্ঠানটি গতকাল সোমবার সরাসরি সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

নাসিহা তাহসিনের উপস্থাপনায় এ আলোচনায় অতিথি ছিলেন মেডিনোভা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড অনকোলজি সেন্টার, বগুড়ার ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. শাকেরা সুলতানা। এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘ডিম্বাশয়ের ক্যানসার’। বাংলাদেশে ডিম্বাশয় ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, ডায়াগনসিস, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, সচেতনতা ও প্রতিরোধব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেন ডা. শাকেরা সুলতানা।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক জানান, ‘বিশ্বব্যাপী নারীদের মধ্যে একটি সাধারণ ক্যানসার হলো ডিম্বাশয় বা ওভারিয়ান ক্যানসার। আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রাই মূলত এর প্রধান কারণ। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি ৮৭ জন নারীর মধ্যে ১ জনের ডিম্বাশয় বা ওভারিয়ান ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এর হার ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে এটি শনাক্ত করা গেলে এই ক্যানসারে বেঁচে থাকার হার ৮৮ শতাংশ।

এরপর তিনি অতিথির কাছে জানতে চান, ডিম্বাশয় ক্যানসারের ঝুঁকি কাদের সবচেয়ে বেশি?

উত্তরে ডা. শাকেরা সুলতানা বলেন, ‘নারীদের প্রজননতন্ত্রের একটি অংশ হলো ডিম্বাশয়। এই ডিম্বাশয় থেকেই ডিম্বাণু তৈরি হয়। এ ছাড়া এখান থেকে বিভিন্ন হরমোন নিঃসৃত হয়। এখানে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলেই ডিম্বাশয়ের ক্যানসার সৃষ্টি হয়। পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের মধ্যেই মূলত এই ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প বয়সী নারীদেরও ডিম্বাশয়ের ক্যানসার দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে যাঁদের বাচ্চা হতে দেরি হয় বা বাচ্চা হয় না, তাঁদের ডিম্বাশয়ে সমস্যা হয়ে থাকে। পাশাপাশি যাঁদের পরিবারে কারও ওভারি, ব্রেস্ট কিংবা কোলন ক্যানসার রয়েছে, তাঁদেরও ডিম্বাশয় ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে।’

ওভারিয়ান ক্যানসারের উপসর্গগুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ডা. শাকেরা সুলতানা বলেন, ‘ডিম্বাশয় ক্যানসারের খুব বেশি উপসর্গ প্রকাশ পায় না বললেই চলে। যার কারণে এই ক্যানসারের শনাক্ত হতে দেরি হয়ে যায়। তবে অনিয়মিত মাসিক, বমি বমি ভাব, খাবারে অরুচি, দুর্বলতা, তলপেট ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে।’

ক্যানসারের স্ক্রিনিং ও ডায়াগনসিসের মধ্যে পার্থক্য কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. শাকেরা সুলতানা বলেন, ‘স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ক্যানসারের লক্ষণ আছে কি না, তা জানা যায় আর ডায়াগনসিসের ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে যায় এবং সেই লক্ষণগুলো দেখে রোগ নির্ণয় করা হয়।’

ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে যেমন সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন করা যায়, ডিম্বাশয় ক্যানসারের ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু রয়েছে কি না? এ প্রসঙ্গে ডা. শাকেরা সুলতানা বলেন, ‘ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন প্রক্রিয়া থাকলেও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া নেই। ডিম্বাশয় ক্যানসারের ক্ষেত্রে ব্লাড টেস্ট ও আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হয়। কারও পরিবারে মা, বোন বা ফুফু—এমন কারও ক্যানসার থাকলে ৩০ বছরের পর থেকেই স্ক্রিনিং শুরু করে দেওয়া উচিত।’

বাংলাদেশে ডিম্বাশয় ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, ডায়াগনসিস, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, সচেতনতা ও প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. শাকেরা সুলতানা (ডানে)
ছবি: প্রথম আলো

ফাইব্রয়েড অথবা ওভারিয়ান সিস্ট ডিম্বাশয় ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. শাকেরা সুলতানা বলেন, ‘এগুলো নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় থাকেন, তবে এগুলোর সঙ্গে ডিম্বাশয় ক্যানসারের আসলে কোনো সম্পর্ক নেই।’

ডিম্বাশয় ক্যানসারের ঝুঁকির কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘যাঁরা নিয়মিত ওভুলেশন ইনডিউসিং ড্রাগ নেন এবং মেনোপজের পরে দীর্ঘদিন হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নেন, তাঁদের ডিম্বাশয় ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। সেই সঙ্গে পরিবারের কারও ক্যানসার হয়ে থাকলে এই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া জীবনযাত্রাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।’

ওভারিয়ান ক্যানসারের চিকিৎসা যেমন কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও ইমিউনোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ডা. শাকেরা সুলতানা বলেন, অন্যান্য চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম থাকলেও কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। কেমোথেরাপি দিলে রোগীদের সাত থেকে আট দিন বমি হয়, খাবারে অরুচি থাকে, চুল পড়ে যায়, ওজন কমে যায়। তবে কেমো শেষ হওয়ার দেড় মাসের পর থেকে এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমে যায়। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে, চুলও গজাতে শুরু করে।

ডা. শাকেরা সুলতানা আরও বলেন, প্রতিক্রিয়া থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবেই। এগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। অনেকেই মনে করেন, কেমোথেরাপি নিলে রোগী বেশি দিন বাঁচেন না ইত্যাদি। তবে এগুলো একেবারেই সঠিক নয়।

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে উপস্থাপক ডা. শাকেরা সুলতানাকে প্রশ্ন করেন, ‘তিনি সচরাচর কোন স্টেজের রোগী দেখতে পান?’

উত্তরে ডা. শাকেরা সুলতানা জানান, বাংলাদেশে রোগীরা সচরাচর লেট স্টেজেই আসেন। তবে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। ধীরে ধীরে অনেকেই এখন এসব বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন।