গ্রামের মানুষ কম যাচ্ছে শহরে

জরিপ বলছে, শহরে অভিবাসন কম হচ্ছে—এটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতা। এ নিয়ে বড় গবেষণা হওয়া দরকার।

গ্রাম থেকে নগরে কম আসছে মানুষ। আট বছর আগের চেয়ে মহানগরগুলোর বস্তিতে, বস্তির বাইরে ও দেশের শহরগুলোতে কম হচ্ছে অভিবাসন। নগরের মানুষের স্বাস্থ্যে ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষ করা যাচ্ছে।

গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন এবং শহরের মানুষের সর্বশেষ স্বাস্থ্য পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে নগর স্বাস্থ্য জরিপ ২০২১ প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদন বলছে, শহরে বাস করেও ১০ শতাংশ খানার দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। শহরে শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর প্রবণতা নিম্নমুখী। এই প্রবণতা শিশুপুষ্টির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনারে দেশের মহানগর ও শহরের মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে এই জাতীয় জরিপের ফলাফল ও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) এই সেমিনারের আয়োজন করে। এই জরিপের নেতৃত্ব দিয়েছে নিপোর্ট।

শহরে-নগরে মানুষ আসা কমছে—এটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তবে করোনার কারণে এমন হচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।
অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন নবী, জনসংখ্যা-বিশেষজ্ঞ

৩০৯ পৃষ্ঠার জরিপ প্রতিবেদনে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের ধরন, শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা পরিস্থিতি, মাতৃ ও নবজাতক সেবা, শিশুস্বাস্থ্য ও শিশুপুষ্টির বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

দেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের বস্তির সাড়ে ১০ হাজার খানা, বস্তির বাইরের ১৮ হাজার খানা এবং জেলা শহর ও পৌরসভার ৭ হাজার ৩৬০টি খানার ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। যেসব পৌরসভার জনসংখ্যা ৪৫ হাজারের ওপরে, তাদের এই জরিপের মধ্যে নেওয়া হয়েছে।

জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১০ জুন পর্যন্ত। এর আগে ২০০৬ সালে ও ২০১৩ সালে একই ধরনের জরিপ করা হয়েছিল। নগর স্বাস্থ্যের জন্য এই জরিপ প্রতিবেদনকে বিশেষ গুরুত্ব দেন গবেষক ও নীতিনির্ধারকেরা।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে একটি চিত্র পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে কৌশল নির্ধারণ সহজ হয়, নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়।

শহরে মানুষ কম আসছে, কেন

মহানগরগুলোর বস্তি, বস্তির বাইরের ও অন্যান্য শহরের নারী ও পুরুষের জন্ম কোথায় অথবা তারা কোথা থেকে এসেছে—এই তথ্য জরিপকারীরা সংগ্রহ করেছেন। মহানগরগুলোর বস্তির ৫৮ শতাংশ নারী ও ৪৮ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, তাঁরা গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন। ছোট শহরের ৩৪ শতাংশ নারী ও প্রায় ১৪ শতাংশ পুরুষ গ্রাম থেকে সেখানে গেছেন। মহানগরের বস্তির বাইরে বসবাস করা নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে প্রায় ৪৬ ও ৩৫ শতাংশ।

আট বছর আগে একই ধরনের জরিপ হয়েছিল। তখন মহানগরের বস্তির প্রায় ৬৭ শতাংশ নারী ও প্রায় ৬৬ শতাংশ পুরুষ বলেছিলেন, তাঁরা গ্রাম থেকে বস্তিতে এসে উঠেছেন। মহানগরের বস্তির বাইরে এবং ছোট শহরে নারী ও পুরুষ আসার হার ২০২১ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে বেশি ছিল। এখন তা কম কেন—এই প্রশ্নের উত্তর জরিপ প্রতিবেদনে নেই।

তবে জরিপ প্রতিবেদনের ওপর নির্ধারিত দুজন আলোচক বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাহদাত হোসেন বলেন, দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। মানুষের শহরে এসে থেকে যাওয়ার প্রয়োজন কমেছে। তবে এ বিষয়ে বিশদ গবেষণা হওয়া দরকার।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন নবী বলেন, শহরে-নগরে মানুষ আসা কমছে—এটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তবে করোনার কারণে এমন হচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার। অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি দেশের গ্রামগুলোর উন্নতি হচ্ছে। প্রায় সব গ্রামে বিদ্যুৎ আছে, কর্মসংস্থান বাড়ছে। এরই প্রতিফলন পড়েছে অভিবাসনে।

জরিপে গ্রাম থেকে শহরে আসার কারণ উঠে এসেছে। পুরুষেরা আসেন মূলত কাজের খোঁজে বা আরও বেশি উপার্জনের আশায়। আর নারীরা আসেন মূলত স্বামীর সঙ্গে থাকার জন্য। তবে একটি বড় অংশ কাজের জন্যও আসে।

নগর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি

জরিপে দেখা গেছে, তিনটি ক্ষেত্রেই (মহানগরের বস্তি, মহানগরের বস্তির বাইরে এবং ছোট শহর) ৯০ শতাংশ খানার বসবাসের স্থানের দুই কিলোমিটারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আছে। এর অর্থ হচ্ছে শহরে বাস করেও ১০ শতাংশ খানার দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিক নেই। মহানগরের বস্তির ৮০ শতাংশ, মহানগরের বস্তির বাইরে ৭৪ শতাংশ এবং ছোট শহরে ৮১ শতাংশ মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী আছেন। তাঁরা মূলত এনজিওকর্মী।

মহানগরের বস্তির বাইরে নারীদের মধ্যে মোট প্রজনন হার ১ দশমিক ৯১। মহানগরের বস্তিতে এই হার ২ দশমিক ১৪। কিন্তু ছোট শহরে এই হার বস্তির চেয়ে বেশি। সেখানে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ২২।

জরিপে দেখা যাচ্ছে, দুটি ক্ষেত্রে কিশোরীদের মধ্যে গর্ভধারণ বেড়েছে। মহানগরের বস্তিতে ২০০৬ ও ২০১৩ সালে ২১ শতাংশ কিশোরী গর্ভধারণ করত। শেষ জরিপে তা বেড়ে হয়েছে ২২ শতাংশ। একইভাবে মহানগরের বাইরের পরিবারগুলোতে আগে কিশোরী গর্ভধারণ ছিল যথাক্রমে ১১ ও ১৩ শতাংশ। ২০২১ সালের জরিপে তা দেখা যাচ্ছে ২০ শতাংশ। তবে দেশের অন্যান্য শহরে এটি ওঠানামার মধ্যে আছে। তবে তিনটি জরিপের তথ্য রাখলে দেখা যায়, প্রসবপূর্ব সেবা নেওয়ার হার নারীদের মধ্যে বাড়ছে। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে সেবা নেওয়াও বাড়ছে।

অস্ত্রোপচারে প্রসবের হার উদ্বেগজনক

দেশের মহানগর ও শহরগুলোতে অস্ত্রোপচারে শিশুজন্ম বাড়ছে। মহানগরগুলোর বস্তিতে ৫৮ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। মহানগরে বস্তির বাইরে এই হার ৭৭ শতাংশ। অন্যান্য জেলা ও ছোট শহরে অস্ত্রোপচারে প্রসবের হার ৭৫ শতাংশ।

জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে উদ্ধৃত করা বলা হয়েছে, ১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। এই প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যু কমাতে সহায়তা করে। প্রয়োজন ছাড়া অস্ত্রোপচার স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে নারীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনজিওচালিত প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম কম হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অস্ত্রোপচার হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সরকারি হাসপাতালে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। বেসরকারি হাসপাতালে এই হার ৭৭ শতাংশ। আর্থিক বিষয় আছে বলে বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম বেশি। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। তিনি আরও বলেন, সরকারি হাসপাতালে সেবার পরিধি ও মান বাড়লে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে কম যাবে। তবে সরকারি হাসপাতালে জনবলের সংকট আছে।

নগরের শিশুদের পুষ্টি

শিশু চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা জন্মের প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। এটা স্বাস্থ্যের ভিত তৈরি করে। জরিপ বলছে, গত আট বছরে দেশের ১১টি মহানগরে শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ার হার কমেছে।

২০১৩ সাল ১১টি মহানগরে বস্তির ৫৯ শতাংশ শিশু ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ খেত। এখন তা কমে হয়েছে ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ শুধু মায়ের দুধ খাওয়া শিশুর হার ৫ শতাংশ বিন্দু কমেছে। এই হার আরও বেশি কমেছে মহানগরগুলোর বস্তির বাইরের পরিবারগুলোতে। আগে ছিল ৫৮ শতাংশ, এখন কমে হয়েছে ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ মহানগরে তুলনামূলকভাবে অবস্থাপন্ন পরিবারে দুধ খাওয়া শিশুর হার ৯ শতাংশ বিন্দু কমেছে।

জরিপ বলছে, বস্তির শিশুরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আছে। বস্তির ৩৪ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। বস্তির বাইরে তা ২৭ শতাংশ। বস্তির শিশুদের মধ্যে কৃশতা ও স্থূলতার হারও বেশি।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদল, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. টিটো মিয়া। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নিপোর্টের মহাপরিচালক মো. শাহজাহান।