স্বামীর সঙ্গে কলহের পরদিন স্কুলশিক্ষিকা আইসিইউতে

স্কুলশিক্ষিকা সুদীপ্তা রায় ঘোষ
ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন বয়স্ক লোক শক্ত কিছু দিয়ে একজন বয়স্ক নারীকে পেটাচ্ছেন। বয়স্ক লোকটিকে থামানোর চেষ্টা করছেন একজন কম বয়সী নারী। বয়স্ক নারীর পরিচিতজনেরা ভিডিওটি শেয়ার করে জানিয়েছেন, নারীর নাম সুদীপ্তা রায় ঘোষ (৬৭), পেশায় শিক্ষক। যিনি পেটাচ্ছেন তিনি তাঁর স্বামী সুনীল রঞ্জন ঘোষ (৭০), রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। কম বয়সী নারী তাঁদের পুত্রবধূ। অভিযোগ উঠেছে, আর্থিক বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে ১৬ জুলাই ওই মারধরের ঘটনা ঘটে এবং এর পরদিন থেকে ছয় দিন ধরে সুদীপ্তা ঘোষ ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে আছেন।

ওই অভিযোগের সূত্র ধরে রোববার বিকেলে প্রথম আলোর প্রতিবেদক হাসপাতালে খোঁজ করতে গেলে চিকিৎসকেরা জানান, মারধর নয়, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবন থেকে সুদীপ্তা ঘোষের অবস্থা সংকটাপন্ন। ওই শিক্ষকের ভাইদের অভিযোগ, স্বামীই খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে বা অন্য কোনোভাবে সুদীপ্তার দেহে অতিরিক্ত ওষুধ প্রবেশ করিয়েছেন। তাঁদের বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করার মতো মানুষ নন।

অপর দিকে স্বামী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, যে ভিডিও ছড়িয়েছে, সেটা দেড় বছর আগের। ১৬ জুলাই রাতে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য ও সামান্য হাতাহাতি হয়েছিল। সেটা মিটেও গিয়েছিল। কলহকে কেন্দ্র করে তাঁর স্ত্রী উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নিয়মিত সেবন করা ওষুধ বেশিমাত্রায় সেবন করে ফেলেছেন।

বিকেলে পপুলার হাসপাতালের অ্যানেক্স ভবনের আইসিইউতে গিয়ে দেখা যায়, লাইফ সাপোর্টে আছেন শিক্ষক সুদীপ্তা রায় ঘোষ। তিনি নড়াচড়া করলেও কথা বলতে পারছেন না, কাউকে চিনতে পারছেন না। কর্তব্যরত চিকিৎসক সুজায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ১৭ জুলাই সুদীপ্তা ঘোষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

অতিরিক্ত ওষুধ থেকে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়েছে। তিনি স্বামীর মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন বলে যে অভিযোগ রয়েছে, এ প্রসঙ্গে এই চিকিৎসক বলেন, সেটা তাঁরা শুনেছেন। তবে দেহে আঘাতের চিহ্ন পাননি।

একই কথা বললেন হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ তন্ময় চক্রবর্তী। তিনি বলেন, শনিবার সুদীপ্তা ঘোষের লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছিলেন না। তখন আবার লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। লাইফ সাপোর্ট যতক্ষণ পর্যন্ত সরানো না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না।

সুদীপ্তা ঘোষ চিকিৎসক মোহাম্মদ সেলিমের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য আমি প্রকাশ করতে চাই না। সেটা পরিবারই ভালো বলতে পারবে। রোগীর ছেলেও চিকিৎসক, তিনি জানিয়েছেন, বাড়িতে ঝগড়া হয়েছিল।’

কী হয়েছিল ওই শিক্ষিকার সঙ্গে?

দেশজুড়ে পারিবারিক সহিংসতার উচ্চ হারের মধ্যে একজন বয়স্ক নারীকেও স্বামীর হাতে মারধরের শিকার হতে দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভে ফেটে পড়েন অনেকে। সুদীপ্তা ঘোষের ‘পাঁচ কোটি টাকা পেতে’ স্বামী ও একমাত্র সন্তান শঙ্খময় ঘোষ তাঁকে নির্যাতন করতেন বলে অভিযোগ করে একটি পক্ষ। আবার আরেকটি পক্ষ এমন অভিযোগও করে, সুনীল ঘোষের সঞ্চয়পত্রের ‘বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার’ চেষ্টা করেছেন স্ত্রী ও ছেলে। তাঁরা সুনীল ঘোষকে মারধর করতেন।

ওই নারীর ছোট ভাই ঝালকাঠির বাসিন্দা কমল কুমার রায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ৪০ বছর আগে পারিবারিকভাবে সুনীল ঘোষের সঙ্গে তাঁর বোনের বিয়ে হয়। তাঁদের ৯ ভাইবোনের মধ্যে সুদীপ্তা ষষ্ঠ। বিয়ের পর থেকেই তাঁর বোনকে নিয়মিত মারধর করেন সুনীল ঘোষ। তিনি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। আর্থিক বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিরোধ বেশি। তাঁরা জমি বিক্রি করে বোনকে দুই দফায় ৫০ লাখ টাকাও দিয়েছেন। তিনি বলেন, বোন ধানমন্ডির একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের শিক্ষক। তাঁর কোচিং সেন্টার রয়েছে। বোনের আয়ের অর্থ নিতেই নির্যাতন করতেন স্বামী।

সুদীপ্তা ঘোষের স্বামী সুনীল ঘোষ বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংগীত পরিচালক। বাড়িতে রবীন্দ্রসংগীত শেখাতেন। আগে বরিশালে কৃষি ব্যাংকে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন।

হৃদ্‌রোগ হওয়ার পর ২০০৭ সালে চাকরি ছেড়ে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে সুনীল ঘোষ বলেন, যে ভিডিও ছড়িয়েছে, সেটা দেড় বছর আগের। মনোমালিন্য হলে তাঁরা দুজনেই একে অপরকে মারেন। তিনি সম্প্রতি ভারতে মেডিকেল পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। সঙ্গে স্ত্রীকে নেননি বলে তিনি কিছুটা রেগে ছিলেন। ঘটনার দিন ১৬ জুলাই এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা–কাটাকাটি হয়। ‘সামান্য হাতাহাতিও’ হয়।

সুনীল ঘোষ বলেন, ‘আমার বয়স ৭০ বছর। বাইপাসের রোগী। আমি কীভাবে এত মারধর করব? আমাদের স্বামী–স্ত্রীর মনোমালিন্য হয়। পাঁচ মিনিটে তা মিটেও যায়। আমরা দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারি না। সেদিন রাগ হয়ে সম্ভবত সে প্রেশার, অ্যাজমা আর ঘুমের ওষুধ একটু বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেলেছিল। পরদিন ঘুম থেকে না ওঠায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’ তিনি বলেন, তাঁদের স্বামী–স্ত্রী ও ছেলের সব টাকা মিলিয়েও এক কোটি টাকা নেই। স্ত্রী দিন–রাত শিশুদের পড়িয়ে যে অর্থ উপার্জন করেন, সেটা সংসারে ব্যয় করেন। তাঁর নিজের সঞ্চয়পত্রও তিনি নিজে, স্ত্রী ও ছেলের নামে ভাগ করে রেখেছেন। টাকা নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিরোধ নেই।

একমাত্র সন্তান শঙ্খময় ঘোষ একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে এখন ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। তাঁর স্ত্রীও চিকিৎসক। তাঁদের একটি শিশুসন্তান রয়েছে।

মাকে বাবার নির্যাতন ও আইসিইউতে ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে ছেলে শঙ্খময় ঘোষ বলেন, ‘যেভাবে শুনেছেন, বিষয়টি তা নয়। আমি এখন রক্ত জোগাড় নিয়ে ছোটাছুটির মধ্যে আছি। এ নিয়ে পরে কথা হবে।’

সুদীপ্তা ঘোষের সবচেয়ে ছোট ভাই কাজল কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সোমবার ঢাকায় এসে সুনীল ঘোষকে আসামি করে ধানমন্ডি থানায় মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।