চলন্ত ট্রেনে আতঙ্কের ভোর

  • পুলিশের ধারণা, আগুন দিয়ে দুর্বৃত্তরা বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যায়।

  • জানানো হয়নি চালককে, পুড়তে থাকা ট্রেন যায় ১২ কিলোমিটার।

  • ২৮ অক্টোবরের পর ট্রেনে নাশকতার পাঁচ ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু।

  • রেললাইনে আরও ১৯টি অগ্নিসংযোগ এবং ৮টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

নেত্রকোনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে ভোররাতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। পুড়ে যাওয়া বগি দেখছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। গতকাল রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনেছবি: প্রথম আলো

নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল সোমবার রাত ১১টার দিকে। গতকাল মঙ্গলবার ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে ট্রেনটি যখন ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন এলাকায়, তখনই সেটিতে আগুন দেওয়া হয়। এতে পুরোপুরি পুড়ে যায় তিনটি বগি।

যাত্রীদের একাংশ বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে গিয়েছিলেন। বাকিদের বেশির ভাগ ছিলেন ঘুমিয়ে। ট্রেনে নারীরা ছিলেন, শিশুরা ছিল, ছিলেন প্রবীণেরাও। সবাই দেখলেন, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে পুরো বগি। এর মধ্যে চিৎকার, কান্না।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনার এই বর্ণনা পাওয়া যায় বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের মুখ থেকে। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, বিমানবন্দর স্টেশন এলাকায় আগুন দেওয়ার পর ট্রেনটি থামে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে এসে ঢাকার তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায়। তখন হুড়োহুড়ি করে যাত্রীরা নেমে যান। কেউ কেউ লাফিয়ে পড়েন।

ট্রেনটি তেজগাঁওয়ে থামার কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নেভাতে শুরু করে। পরে একটি বগি থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন নাদিরা আক্তার (৩২) এবং তাঁর তিন বছরের ছেলে ইয়াছিন রহমান। অন্য দুজনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। শনাক্ত না হওয়া লাশ দুটির একটি রশিদ ঢালী (৬০) নামের এক ব্যক্তির বলে তাঁর স্বজনেরা দাবি করেছেন। অন্য লাশটি একজন পুরুষের।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে হরতাল-অবরোধের মধ্যে এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চারটি ট্রেনে আগুন দেওয়া এবং রেললাইন কেটে ফেলার একটি ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গতকালের চারজনসহ মারা গেছেন পাঁচজন।

রেললাইনে আরও ১৯টি অগ্নিসংযোগ এবং ৮টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকায় রেলভবনে গতকাল পূর্বনির্ধারিত এক সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যোগাযোগব্যবস্থায় যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল, সেখানে একমাত্র রেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল। এখন রেল যোগাযোগব্যবস্থায় পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে।

নাশকতার কারণে রেল চলাচল বন্ধ হবে না জানিয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতেই পারে। কিন্তু সহিংসতা করতে পারে না। সহিংসতা করে রেল চলাচল বন্ধ করা যাবে না।

সারা দেশে গতকাল বিএনপির ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ছিল। হরতাল শুরুর আগে এই আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ১৫০ জন শিক্ষক।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলের বিজয় শোভাযাত্রায় গতকাল বলেন, যারা রেলে আগুন দিয়ে শিশুসহ চারজনকে হত্যা করেছে, তাদের কোনো ক্ষমা নেই।

সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপির পক্ষ থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে অনলাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার নাশকতা করে হরতাল-অবরোধকারীদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। কে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তা সুস্পষ্ট। এ ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে।

আগুন নিয়ে ১২ কিলোমিটার

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগ ও রেলওয়ে পুলিশ ট্রেনে থাকা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছে, তাদের ধারণা, যাত্রীবেশে ওঠা দুর্বৃত্তরা ট্রেনটিতে আগুন দিয়ে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে যায়। স্টেশনটি পার হওয়ার পর যাত্রীরা বুঝতে পারেন, ট্রেনে আগুন লেগেছে। কিন্তু ট্রেনের চালক (লোকোমাস্টার) পর্যন্ত এই তথ্য পৌঁছায়নি।

পুলিশ আরও বলছে, বিমানবন্দর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে তেজগাঁও রেলস্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছার পর চালককে বিষয়টি জানান ট্রেনের পরিচালক। তখন ট্রেন থামানো হলে যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নেমে যান।

ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনায় আহত হয়েছেন নুরুল হক আবদুল কাদের নামের এক ব্যক্তি। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, তিনি যে বগিতে ছিলেন, সেখানেই আগুনের সূত্রপাত।

নুরুল হকের ভাষ্য, বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পরই আগুন দেখতে পান তিনি। তখন নিরাপত্তাকর্মীদের পোশাক পরা কয়েকজন অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরই দেখা যায় চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। তখন ট্রেন অনেক গতিতে চলছিল। দরজা খুলে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। ধোঁয়ার কারণে তিনি নিশ্বাস নিতে পারছিলেন না। তেজগাঁও স্টেশনের কাছাকাছি আসার পর তিনি ট্রেন থেকে লাফ দেন।

প্রতিটি ট্রেনে রেলওয়ের পক্ষ থেকে একজন করে পরিচালক থাকেন, ট্রেনের সার্বিক দায়িত্ব তাঁর। প্রতিটি বগিতে একজন করে সুপারভাইজার (তত্ত্বাবধায়ক) থাকেন। আগুন লাগার তথ্য দ্রুততম সময়ে চালককে (লোকোমাস্টার) জানানোর দায়িত্বও সুপারভাইজারদের।

রেলওয়ে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বগির সুপারভাইজারের কাছে ট্রেনের পরিচালক ও চালকের মুঠোফোন নম্বর ছিল না বলে জানা গেছে। এ কারণে তাঁরা আগুন লাগার তথ্য পরিচালক বা চালককে জানাতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার জন্য চালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের চালকের দায়িত্বে ছিলেন দিলীপ কুমার মণ্ডল। তিনি ১০ বছর ধরে ট্রেনচালকের চাকরি করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বগিতে আগুন লাগলে সেই তথ্য তাঁকে না জানালে সেটি চালকের আসনে বসে বোঝা প্রায় অসম্ভব। তেজগাঁও রেলস্টেশনে এসে বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ট্রেন থামিয়ে দেন।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশারফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেনটিতে ১৪টি বগি ছিল। তিনি ছিলেন একেবারে শেষ বগিতে। আগুন লাগে সামনের দিক থেকে ৬ নম্বর বগিতে। আর পেছন থেকে ৮ নম্বর বগিতে। তিনি বলেন, তেজগাঁও রেলস্টেশনে প্রবেশ করার সময় সিগন্যাল অনুকূলে আছে কি না, সেটি পরীক্ষা করার জন্য তিনি জানালা দিয়ে তাকালে আগুন ও ধোঁয়া দেখতে পান। তখনই তিনি ট্রেনের চালককে মুঠোফোনে বিপদের সংকেত দেন। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন থামানো হয়।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, তারা আগুনের খবর পায় ৫টা ৪ মিনিটে। তাদের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে আট মিনিট পরে পৌঁছে আগুন নেভাতে শুরু করে। প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় তারা আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। একটি বগি থেকে চারটি লাশ উদ্ধার করে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে ঘটনাস্থলে যায় রেলওয়ে পুলিশ। রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক দিদার আহম্মদ তেজগাঁও রেলস্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে গতকাল সকালে বলেন, কারা আগুন দিয়েছে, তা উদ্ঘাটনে রেলওয়ে পুলিশ এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশের অন্যান্য ইউনিটও কাজ করছে। শিগগিরই এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহত একজনকে দেখতে যান। সেখানে তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন কিছুদিন যাবৎ হরতাল এবং অবরোধের নামে জনগণের জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন সেই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে মনে করছে।

রেলে আগুনের যত ঘটনা

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জানান, গত ২৮ অক্টোবরের পর ট্রেনে আগুনের প্রথম ঘটনা ঘটে গত ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইলে কমিউটার ট্রেনে। ১৯ নভেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে যমুনা এক্সপ্রেসে এবং ২২ নভেম্বর সিলেটে উপবন এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়া হয়।

গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে ১৩ ডিসেম্বর ২০ ফুট রেললাইন কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের সাতটি বগিই লাইনচ্যুত হয়েছিল। তখন একজন যাত্রী মারা যান, ৫০ জন আহত হন। গতকাল কুড়িগ্রামের রাজারহাটে রংপুর-কুড়িগ্রাম রেলপথের কিছুসংখ্যক ‘হুক বোল্ট’ খুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে গতকাল আগুনের ঘটনায় যাত্রীদের অনেকে মুঠোফোনে স্বজনদের খবরটি দিয়েছিলেন। স্বজনেরাও ছুটে গিয়েছিলেন তেজগাঁও স্টেশনে। তাঁদের একজন মিজানুর রহমান, যাঁর স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান ও শ্যালক ছিলেন ওই ট্রেনে।

মিজানুর জানান, বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিমকে (চতুর্থ শ্রেণিপড়ুয়া) নিয়ে শ্যালক হাবিবুর রহমান ট্রেন থেকে নেমে যেতে পেরেছিলেন। আটকা পড়েন তাঁর স্ত্রী নাদিরা আক্তার (৩২) ও ছেলে ইয়াছিন রহমান (৩)। এই দুজনের পুড়ে যাওয়া লাশ বের করা হয়। মৃত্যুর সময় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন নাদিরা।

বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে স্ত্রী-সন্তানের লাশের দিকে তাকিয়ে থাকা মিজানুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কারও কাছে বিচার চাইব না।’