প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান চাই

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।

রাশেদ খান মেনন, মো. জোহর আলী, তাহেরা জাবিন, মো. শফিকুল ইসলাম, তাওহিদা জাহান ও গোলাম ফারুক হামিম
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানসহ সার্বিক সুরক্ষায় আইন, নীতি, সনদ ও কর্মকৌশল আছে। এগুলো বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যাতে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যায়, সে দিকে নজর বাড়াতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এ কথা বলেছেন।

এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলো যৌথভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। আলোচকেরা কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর বিষয়টিতে জোর দেন।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় আইনগত সুরক্ষার কমতি নেই। তবে এই ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান নিশ্চিতে আমরা পিছিয়ে আছি। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে না। শ্রবণ-বাক্‌প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট করার ঘোষণা দিয়েও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রযুক্তিগত সুবিধা তৈরি হচ্ছে, কিন্তু রিসোর্স পারসন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে পরিসংখ্যানগত সমস্যা তো আছেই, এটা দূর করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে।’

আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. জোহর আলী বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণে কাপড় সেলাই বা কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ঘরে বসে আয় করার জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই) মহাব্যবস্থাপক ফারজানা খান জানান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা করে কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না। তবে জাতীয় মেলায় প্রতিবন্ধী উদ্যোক্তারা স্টল দিচ্ছেন, তাতে ভালো বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আগ্রহী হলে মানসিক সমস্যা লাঘবে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স, অনলাইনে ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণে আলাদা করে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (রিসোর্স সিস্টেম অ্যান্ড কালচার) মো. শফিকুল ইসলাম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে গতানুগতিক চিন্তার গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন এবং সরকারি পর্যায়ের প্রতিবন্ধিতা-বিষয়ক কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করার সুপারিশ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাওহিদা জাহান প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে দৈনন্দিন কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পাবেন না, তাঁদের জন্য কারিগরি শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং স্নায়বিক বিকাশজনিত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে কোটা চালু করেছে বলেও জানান তিনি।

ব্রিটিশ হাইকমিশন ঢাকার সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার তাহেরা জাবিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলে এই ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা করাও সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান নিয়ে এডিডি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রকল্পের অভিজ্ঞতা ও সুপারিশ তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ প্রোগ্রাম টিম লিড গোলাম ফারুক হামিম। ৪৯টি জেলায় বাস্তবায়িত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানবিষয়ক প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ব্র্যাকসহ বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় ১ হাজার ১৯২ জনের প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি জানান, দেশের ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৬৬ শতাংশের বেশি কোনো আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত নন।

সিএসআইডির নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জহুরুল আলম সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কেবল প্রতিবন্ধী ভাতা, এতিম লালন-পালনের মতো কাজে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এবারের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ২০০ জনের বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি লিখিত পরীক্ষায় পাস করলেও কারও চাকরি হয়নি, বিষয়টিতে রিট পর্যন্ত করতে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বলেন, যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা চাকরি পাচ্ছেন, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। তিনি বলেন, পোশাকশিল্প কারখানাগুলো কিছুটা এগিয়ে এলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মসংস্থানে এগিয়ে আসছে না।

 রাজশাহীর রজনীগন্ধা উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি আসাদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সহায়ক সুযোগ-সুবিধা পেলে কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অসম্ভব কিছু না।

সাইটসেভারস বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক উৎপল মল্লিক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তা পাওয়া না গেলে নিজেরা সংগঠিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে বলে উল্লেখ করেন।

ইউসেপ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক মাহমুদ হাসান তালুকদার কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য ‘স্কিল নিডস ম্যাপিং’ করার সুপারিশ করেন। বাংলাদেশ বিজনেস ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুর্তেজা খান জানান, প্রবেশগম্যতার সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দীর্ঘ মেয়াদে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্র্যাকের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যবস্থাপক এম মাহজুজ আলী প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান নিশ্চিতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

সিডিডির উন্নয়ন ব্যবস্থাপক সাজ্জাদ কবীর বলেন, চাকরি পেতে অভিজ্ঞতা লাগবে—এ ক্রাইটেরিয়াতেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাদ পড়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, শিক্ষাসহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যোগ্যতাটা অর্জন করবেন কোথা থেকে? তিনি এই মানুষগুলোর জন্য বাড়িভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেন।

গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।