শূন্য থেকে শিল্প গড়ে তাঁর বিদায়

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের একজন সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান মারা গেছেন।

ফজলুর রহমান

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের একজন সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল সোমবার ভোররাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

দেশের যে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা একেবারে শূন্য থেকে বড় হয়েছিলেন, তাঁদের একজন ফজলুর রহমান। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি মুদিদোকান দিয়ে তাঁর ব্যবসাজীবন শুরু। পুঁজি ছিল মাত্র ৪২ টাকা। মৃত্যুর আগে ফজলুর রহমান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ৪০টি শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সিটি গ্রুপ জানিয়েছে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করে পরিবার চলে ৩০ হাজার মানুষের।

ফজলুর রহমানের ব্যবসাজীবন শুরু হয়েছিল কৈশোরকালে। ১১ ভাই-বোন, মা–বাবাসহ তাঁদের পরিবার ছিল বড়। বাবার হঠাৎ অসুস্থতার কারণে ফজলুর রহমানকে ব্যবসায় নামতে হয়। সেটি ১৯৫৭-৫৮ সালের কথা। এরপর ছয় দশকে তিনি একের পর এক কারখানা করেছেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এমনকি মৃত্যুর আগের দিন রোববারও অফিসে গেছেন। বেরিয়েছিলেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে।

স্বজনেরা জানান, বাসায় ফেরার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল। রাতে ঘুমানোর পর দুইটার দিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই ভোররাত চারটার দিকে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

ফজলুর রহমানের বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাসস জানায়, গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ অনেকে ফজলুর রহমানের মৃত্যুতে শোক জানান। গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা খেলার মাঠে ফজলুর রহমানের জানাজায় উপস্থিত হন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ অনেকে। জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ পুরান ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। পুরান ঢাকায়ই ফজলুর রহমান বড় হয়েছেন। পৈতৃক বাড়িও সেখানে, গেন্ডারিয়ায়।

২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফজলুর রহমান জানিয়েছিলেন, বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ১০-১১ বছর বয়সে তিনি যে মুদিদোকান দেন, তাতে দিনে শ দেড়েক টাকার বেচাকেনা হতো। সেখান থেকে ২০-৩০ টাকা লাভ হতো। এই আয় ও কিছু কৃষিজমির ফসল বিক্রির টাকা দিয়ে তাঁদের সংসার কোনোরকমে চলত।

সাক্ষাৎকারে ফজলুর রহমান আরও বলেন, ‘মনে আছে, ডালপুরি বা তেহারির মতো ভালো কিছু খেতে হলে আমাদের নানুর বাড়িতে যেতে হতো। তাঁদের অবস্থা ভালো ছিল।’

ধাক্কা খেয়েছেন, উঠে দাঁড়িয়েছেন

ফজলুর রহমানের শিল্পকারখানার প্রতিষ্ঠা শুরু ১৯৭২ সালে, গেন্ডারিয়ায় একটি শর্ষের মিলের মাধ্যমে। সেখান থেকে এ পর্যন্ত আসার যাত্রাটি সহজ ছিল না। ধাক্কা খেয়েছেন, সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবার যাত্রা শুরু করেছেন। তিনি যখন ব্যবসায় নামেন, তখন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের দাপট। বাঙালি উদ্যোক্তা ছিলেন খুবই কম।

কারখানা করার সাহস কই পেলেন? টাকাপয়সা নিয়ে নামতে তো সাহস লাগে—প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের এই প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেছিলেন, ‘আসলে সাহস ছিল না। আমি ভাবতাম, তাঁরা (পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ী) যদি করাচি থেকে এসে পারেন, আমরা কেন পারব না। আমাদের তো খরচ কম—বাসি ভাত খেলেও চলে, গুলগুলা খেলেও চলে।’

সাহস নিয়ে ব্যবসা শুরুর পর ১৯৮৮ সালে বড় ধাক্কা খান ফজলুর রহমান। সেই বছর ভয়াবহ বন্যায় তাঁর শর্ষের গুদামে পানি ঢুকে যায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর দেখা যায়, শর্ষে পচে গেছে। তিনি পরের বছর আবার শর্ষে কেনেন। সে বছর পানের বরজে শর্ষের খইলের চাহিদা বেড়ে যায়। ভালো ব্যবসা করে ঘুরে দাঁড়ান তিনি।

সিটি গ্রুপের এখন ভোজ্যতেল ও চিনি পরিশোধন, চাল-ডাল, আটা-ময়দা, প্রক্রিয়াজাত খাবার, পোলট্রি খাদ্য, জাহাজ নির্মাণ, চা–বাগান, ব্যাংক ও বিমা, হাসপাতাল, অর্থনৈতিক অঞ্চল ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। সিটি গ্রুপের তীর এখন দেশের সুপরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর একটি।

আরও পড়ুন

‘তিনি একজন অধিনায়ক’

ফজলুর রহমানের ডায়াবেটিস ছিল। ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন। এ কারণে কয়েক বছর ধরে তাঁকে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন নিতে হতো। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে কোনো বিরাম দিতেন না।

সিটি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, শেষ দিন পর্যন্ত ফজলুর রহমান সিটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সামলেছেন বিরাট এই ব্যবসা।

ফজলুর রহমানের মৃত্যুর খবর শুনে গতকাল সকালেই তাঁর গুলশানের বাসায় ছুটে যান রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও শুভানুধ্যায়ীরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা হাসান মাহমুদ রাজা ও বর্তমান চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন হাসান রশীদ, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, রাজনীতিবিদ আন্দালিব রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক হেলাল উদ্দিন প্রমুখ।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) পক্ষে শ্রদ্ধা জানাতে ফজলুর রহমানের গুলশানের বাসায় গিয়ে সংগঠনটির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ফজলুর রহমান ছিলেন দেশের শিল্প খাতের অন্যতম একজন অধিনায়ক। দেশ আজ যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পর্যায়ে এসেছে, সেখানে তাঁর মতো ব্যবসায়ীর বড় অবদান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশে ঋণখেলাপিসহ কত সমস্যা রয়েছে। কিন্তু গত ৩০ বছরে ফজলুর রহমানের বিষয়ে এ রকম কিছু শুনিনি।’

বিকেলে ফজলুর রহমানের জানাজায় রাজনীতিবিদদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম, ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার প্রমুখ। ব্যবসায়ীদের মধ্যে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, আকিজ বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার–উল আলম চৌধুরী, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয়সহ অনেকে জানাজায় অংশ নেন।

জানাজার আগে ফজলুর রহমানের ছেলে মো. হাসান সবার কাছে তাঁর বাবার জন্য দোয়া চান।

পরিশ্রম ও সততার কথা বলতেন তিনি

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফজলুর রহমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশ প্রথম প্রজন্মের একজন শিল্পোদ্যোক্তাকে হারাল। নিজের ৭৬ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন।

ফজলুর রহমান মনে করতেন, তরুণেরা যা-ই করতে চাক না কেন, তাঁদের চেষ্টা থাকতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি হয়তো নয়ছয় করে কিছু করতে পারেন, তবে সেই সাফল্য সাময়িক।’

ফজলুর রহমানের আরেকটি মূলমন্ত্র ছিল। সেটি হলো সৎ থাকা। তিনি বলেছিলেন, ‘সৎ না থাকলে ব্যাংক আপনাকে টাকা দেবে না। সরবরাহকারীরা আপনাকে পাঁচ টাকার পণ্যও দেবে না। এর বিকল্প কিছু নেই।’

আরও পড়ুন