আলিফার চিঠিতে মুগ্ধ সি চিন পিং, জানালেন শুভকামনা
২০১০ সালের ১২ নভেম্বর। চট্টগ্রাম নৌবাহিনী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হন জান্নাতুল ফেরদৌস। সন্তানসম্ভবা এই নারী ভুগছিলেন উচ্চ রক্তচাপে ও হৃদ্রোগে। মা ও সন্তান দুজনের জীবন সংকটাপন্ন। স্ত্রী ও অনাগত সন্তানকে নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠায় তখন আনোয়ার হোসেন। ঘুরছেন চিকিৎসকের পেছনে পেছনে। কী হবে, দুজনই বাঁচবে তো—এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল আনোয়ারের মাথায়।
আনোয়ার হোসেন মেরিন ফিশারিজ একাডেমির পাচক ও তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস নৌবাহিনী হাসপাতালের অফিস সহায়ক।
জান্নাতুল ও তাঁর সন্তানের জীবন বাঁচাতে চট্টগ্রাম নৌবাহিনী হাসপাতালের চিকিৎসকেরা আনোয়ার হোসেনকে পাঠালেন ‘আর্ক পিস’ জাহাজে। সেটি ছিল চীনা নৌবাহিনীর অত্যাধুনিক ভাসমান হাসপাতাল। সেখানে ছিলেন বিশ্বসেরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। আনোয়ারের কাছ থেকে সব শুনে সেখানকার চিকিৎসকেরা এলেন নৌবাহিনী হাসপাতালে। তাঁরা জান্নাতুলের সফল অস্ত্রোপচার করেন। জন্ম হয় আলিফার। পরে চীনা চিকিৎসকদের প্রতি আবেগে ও কৃতজ্ঞতায় মা-বাবা মেয়ের নাম রাখলেন ‘চীন’। পুরো নাম আলিফা চীন।
চট্টগ্রাম বিএফ শাহীন কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী এখন আলিফা। গত ১৫ এপ্রিল আলিফা চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কাছে একটি চিঠি লিখেছিল। সে বাংলাতেই লিখেছিল চিঠিটি। পরে বাংলাদেশের চীনা দূতাবাস তা ইংরেজি করে প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দেয়। চিঠিতে আলিয়া মা-বাবার মুখে শোনা তার জন্মের সময়কার ঘটনা তুলে ধরে। পাশাপাশি চীনে গিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ে মানুষের সেবা করার আগ্রহ প্রকাশ করে।
সম্প্রতি ওই চিঠির জবাব এসেছে। গত সোমবার ঢাকার চীনা দূতাবাসে দেশটির ভাইস মিনিস্টার সান ওয়েইডং আলিফার হাতে প্রেসিডেন্টের চিঠির একটি কপি বাঁধাই করে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন। প্রেসিডেন্ট চীনা ভাষাতেই চিঠির জবাব দেন। পরে দূতাবাস তা ইংরেজি ও বাংলা করে আলিফাকে বাঁধাই করে দেয়। গতকাল বুধবার ঢাকার চীনা দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়, সি চিন পিং আলিফার চিঠি পেয়ে দারুণ খুশি।
প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে চিঠির জবাব পেয়ে আরও খুশি আলিফা ও তার পরিবারের সদস্যরাও। খুশিতে আত্মহারা আলিফা প্রথম আলোকে বলে, সে দারুণ খুশি। প্রেসিডেন্ট চিঠির জবাব দেবে, তা সে ভাবেনি।
আলিফার বাবা আনোয়ার হোসেন আজ বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদককে জানান, মেয়ের জন্মের সূত্র ধরে চীনের সঙ্গে তাঁদের এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মেয়ের জন্মের সময়টার কথা স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তানের জীবন বাঁচাতে আমি ছুটে গিয়েছিলাম সেই জাহাজে। সেখানকার চিকিৎসকদের বিপদের কথা জানাই। সব কথা শুনে চীনা চিকিৎসকেরা নৌবাহিনী হাসপাতালে আসেন। চার সদস্যের একটি চিকিৎসক দল অস্ত্রোপচার করার পর আলিফার জন্ম হয়। মা ও মেয়ে দুজনই সুস্থ ছিলেন। নৌবাহিনী হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও দারুণভাবে সাহায্য করেছিলেন। এরপর চীনা চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
আলিফা চীন ছাড়াও আনোয়ার হোসেন ও জান্নাতুল ফেরদৌস দম্পতির আরও এক সন্তান আছে। তার নাম আবিদুল ইসলাম। বয়স দশের কাছাকাছি। তাঁরা চট্টগ্রাম নগরের বন্দরটিলা এলাকার ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানার গন্ধর্বপুর গ্রামে।
আনোয়ার হোসেন জানান, আলিফার জন্মের পর আরও বেশ কয়েকবার চীনা চিকিৎসকেরা এ দেশে এসেছিলেন। প্রতিবারই তাঁরা আলিফার খোঁজখবর নিয়েছেন। এমনকি ২০১৯ সালে চিকিৎসক দলের আমন্ত্রণে তাঁরা সবাই মিলে চীনে গিয়েছিলেন। ‘আর্ক পিসে’র ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের কাজ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) আলিফার পড়াশোনার খরচ বহন করছে।
সি চিন পিংয়ের চিঠিতে যা আছে
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আলিফার চিঠির জবাবে বলেছেন, ‘তোমার চিঠি পেয়ে খুশি হলাম। তোমার গল্প আমাদের দুই দেশের মৈত্রীর সুন্দর উদাহরণ। প্রাচীনকাল থেকেই চীন ও বাংলাদেশ ভালো প্রতিবেশী ও ভালো বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্বের ইতিহাস এক হাজারের বেশি সময়কার। অন্তত ৬০০ বছর আগে চীনের মিং রাজবংশের নাবিক চ্যাং হোর দুবার বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। এর মধ্য দিয়েই দুই দেশের জনগণের মধ্যে মৈত্রীর বীজ বপন করা হয়েছিল।…’
সি চিন পিং চিঠিতে আলিফাকে আরও বলেছেন, ‘তুমি বলেছিলে বড় হয়ে চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের দূত হতে চাও। আবার আশা করো, ভবিষ্যতে চীনে লেখাপড়া করে একজন ভালো চিকিৎসক হয়ে তোমার “চীনা মা”য়ের (অস্ত্রোপচারে অংশ নেওয়া চিকিৎসকদের একজন) মতো মানুষের প্রাণ বাঁচাবে। এসব জানতে পেরে আমি খুব খুশি হয়েছি। আশা করি, তুমি ভালো করে লেখাপড়া করে তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।…’