এখন তো দুর্নীতিগ্রস্তের সঙ্গে সন্তানের বিয়ে দিতে লাফ দিয়ে চলে যাই: অর্থ উপদেষ্টা
দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম, খুব কম শুনতাম দুর্নীতি। দুর্নীতিগ্রস্ত লোককে আমরা দূর থেকে, আমার বাবারাও এভয়েড করত। যে লোকটা করাপশন করে, দূরে থাকি। ইভেন ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করত। এখন তো আমরা লাফ দিয়ে চলে চাই বিয়ে দিতে, দুর্নীতিগ্রস্তের সঙ্গে। দুর্নীতি কোনো ব্যাপারই না, টাকাপয়সা আছে, ওকে।’
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভার প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এ কথাগুলো বলেন। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা: গড়বে আগামীর শুদ্ধতা’ শীর্ষক এ সভার আয়োজন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুর্নীতিবাজ লোকের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এমনকি তাদের শাস্তিও হয় না বলে মন্তব্য করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘তাদের ছেলেমেয়েরা মহানন্দ করে বেড়ায়। কারও কারও সন্তান নাকি সকালের নাশতার পেছনেই ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করে।’ এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক সচেতনতা যদি না থাকে, দুর্নীতিকে যদি ঘৃণা না করা হয়, তাহলে দুর্নীতি শেষ হবে না বলে মত দেন তিনি।
অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, দুর্নীতি রোধে শুধু উপদেশ নয়, কার্যকর শাস্তি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সমাজকে দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে হবে এবং তথ্য শেয়ারিং বাড়াতে হবে।
আইন প্রণয়ন যত জরুরি, তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইন প্রয়োগ বলে মনে করেন উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। উন্নত দেশগুলোর মতো কড়াকড়ি চেক-অ্যান্ড-ব্যালেন্স, ক্রেডিট রেটিং ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি শক্তিশালী হলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে আসবে বলেও জানান তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মহাপরিচালক এ কে এনামূল হক বলেন, দুর্নীতি কেবল শাস্তি দিয়ে শেষ করা যায় না, এ জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা, নৈতিক মূল্যবোধ ও ধারাবাহিক চেতনা। তিনি বলেন, দেশে ১৪ থেকে ১৫ রকমের দুর্নীতি রয়েছে।
দুর্নীতি নিয়ে গণভোট হলে শতভাগ মানুষই দুর্নীতির বিপক্ষে থাকবে। এরপরও দেশে দুর্নীতি হচ্ছে এবং দুদককে কাজ করতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার আগে অর্থমন্ত্রী পালিয়ে গেলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও পালিয়ে গেলেন। অর্থব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, মোটামুটি কেউই দেশে থাকলেন না। পালিয়ে গেলেন আমাদের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও। আরও বিস্ময়কর, পালিয়ে গেলেন বায়তুল মোকাররমের খতিব। দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে কোথায় পৌঁছেছে, এটা এখান থেকে অনুমেয়।’
দুর্নীতির শুরুতে বন্ধ করা গেলে গত ১৫ থেকে ১৬ বছরের ভোগান্তি হতো না বলেও জানান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। এ প্রসঙ্গে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পদ বিবরণীর অসংগতি তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। তিনি জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন, তদন্তে দেখা যায়, কৃষিজমি ৫ দশমিক ২ একর দেখালেও বাস্তবে ছিল ২৯ একর। ঘোষিত গাড়ির বাইরে আরও দুটি গাড়ি পাওয়া যায়, যার ট্যাক্সও পরিশোধ করা হয়নি। এসব অসংগতি ধরা পড়লে তাঁর মনোনয়ন বাতিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুদকে তখন বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। এগুলো চেপে না গেলে তাঁর নমিনেশন বাতিল হতো, তিনি নির্বাচন করতে পারতেন না, প্রধানমন্ত্রীও হতে পারতেন না। নির্বাচন সামনে রেখে সঠিক ও সৎ নেতৃত্ব বেছে নেওয়া জরুরি। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে আবারও নির্বাচিত করলে সুশাসন সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলী আকবার আজিজী, কমিশনার (অনুসন্ধান) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ, সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীম প্রমুখ বক্তব্য দেন।